
|| শেখ শাহরিয়ার | জেলা প্রতিনিধি (খুলনা) ||
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে নানা স্থানে নতুন করে উত্থান ঘটেছে স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর। খুলনা শহরের দৌলতপুর থানা এলাকার মহেশ্বরপাশা এখন তেমনই এক আতঙ্কের নাম। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা ও দখলবাজি ঘিরে সেখানে একের পর এক খুন, হামলা ও গুলির ঘটনায় উঠে আসছে ‘হুমা বাহিনী’র নাম।
শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরের এই এলাকায় গত সাড়ে তিন মাসে তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। পাশাপাশি একাধিক কুপিয়ে জখম ও প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, হুমায়ুন কবির হুমা ও তার অনুসারীরাই এসব ঘটনার পেছনে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়ার বাসিন্দা মতলেব শেখের ছেলে হুমায়ুন কবির হুমা (৩৭) একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। গত বছরের ৯ অক্টোবর বাগেরহাটের রামপাল থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। চলতি বছরের ২৪ জুলাই জামিনে বেরিয়ে পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকার অন্যান্য সন্ত্রাসী কারাগারে থাকায় হুমা এখন একক নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছেন। তার লোকজন প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর দুটি বাড়িতে ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা—যার সঙ্গে হুমা বাহিনীর সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় ওসমান ও সেলিম নামের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ক্রমাগত সহিংসতায় মহেশ্বরপাশার সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমাদের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, তবুও ৯ রাউন্ড গুলি করেছে। ওরা বলেছে, ওদের ছাড়া এলাকায় কেউ থাকতে পারবে না।”
১১ জুলাই মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি ও রগ কেটে হত্যা করা হয়। পুলিশ পরে হুমার সহযোগী কাজী রায়হান ও আসিফ মোল্লাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে উঠে আসে—মাদক ও দখল নিয়ে হুমার সঙ্গে মাহবুবের দ্বন্দ্ব ছিল।
এর আগেও ২০১৪ সালে যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেন হত্যাকাণ্ডেও হুমার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক আরও দুটি খুনে—৩ আগস্ট ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদার ও ১ অক্টোবর তানভীর হাসান শুভ হত্যায়—হুমা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা সন্দেহ করছে পুলিশ।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার (উত্তর) তাজুর ইসলাম বলেন,
“তিনটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যোগসূত্র আছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে এ অঞ্চলে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক কার্যক্রম ছিল। দীর্ঘদিন দমন হওয়ার পর গত বছরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সেই পুরনো মুখগুলোর অনেকেই এলাকায় ফিরে আসে। তাদের মধ্যে বড় শাহীন, হোসেন ঢালী, আরমান ও হুমা পুনরায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১৫ মার্চ বড় শাহীন খুন হওয়ার পর হুমা নিজস্ব বাহিনী গঠন করে।
দৌলতপুর থানা থানা জামায়াতের আমির মোশাররফ আনসারী বলেন, “একই এলাকায় এত হত্যাকাণ্ডের পরও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের ব্যর্থতাতেই সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া।”
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতা শেখ আশরাফ উজ জামান জানান, “অভিযুক্তদের দ্রুত জামিন পাওয়া ও রিমান্ড না হওয়া—এটিই সন্ত্রাসীদের উৎসাহ দিচ্ছে।”
কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার এ প্রতিনিধি কে বলেন, “এগুলো পেশাদার হত্যাকারীর কাজ। ঘটনা ঘটিয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। তারপরও আমরা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয়দের সহযোগিতাও প্রয়োজন। সবাই মিলে রুখে না দাঁড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।”
