বুধবার, ডিসেম্বর ৩

খুলনায় নিয়ন্ত্রণহীন ছয় সন্ত্রাসী বাহিনী: মাদক সিন্ডিকেটের আধিপত্যযুদ্ধে অর্ধশত খুন, আতঙ্কে নগরবাসী

|| শেখ শাহরিয়ার | জেলা প্রতিনিধি (খুলনা) ||

খুলনা নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত ১৬ মাসে চরমভাবে অবনতি ঘটেছে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, এলাকা দখল এবং প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বে ছয়টি সন্ত্রাসী বাহিনী প্রতিদিনই খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে। পুলিশ–র‌্যাবের দুর্বল অভিযানের সুযোগে এই গ্রুপগুলো এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে শহরবাসী কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে।

খুনের সাম্প্রতিক ঢেউঃ

মাত্র নভেম্বর মাসেই খুলনায় সংঘটিত হয়েছে সাতটি হত্যা। আদালত চত্বরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে।
১৬ নভেম্বর একই পরিবারের তিনজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে। রাতে করিমনগরের বাসায় ঢুকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয় আলাউদ্দিন মৃধাকে। ২৭ নভেম্বর ছুরিকাঘাতে নিহত হন যুবক ইশান।

সর্বশেষ গতকাল আদালত চত্বরে আরও দুটি খুনের ঘটনা ঘটলো।নিহতরা হল- খুলনার নতুন বাজার এলাকার হাসিব ও নগরীর বাগমারা এলাকার রাজ।

ছয় সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্যঃ

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে খুলনায় যে ছয়টি সন্ত্রাসী বাহিনী প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে সেগুলো হলো—
গ্রেনেড বাবুর ‘বি কোম্পানি’
আশিক বাহিন
নূর আজিম বাহিনী
পলাশ বাহিনী
চরমপন্থী হুমা বাহিনী
দৌলতপুরের আরমান বাহিনী
আরমান ও নূর আজিম কারাগারে থাকলেও সেখান থেকেই নিজেদের বাহিনী পরিচালনার নির্দেশ দিচ্ছেন বলে জানায় একাধিক তদন্ত সংস্থা।

মাসে ৭০–১০০ কোটি টাকার মাদক বাণিজ্যঃ

এই ছয় গ্রুপের মধ্যে প্রতিদিনের সংঘর্ষের মূল কেন্দ্র মাদক কারবার।

গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী—
খুলনায় মাসে ৭০–১০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়।
এর অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে গ্রেনেড বাবু।

পাঁচ শতাধিক সদস্য নিয়ে গ্রেনেড বাবু পরিচালনা করছে সবচেয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
এলাকা ভাগাভাগি আর টাকা–অংশীদারিত্বের দ্বন্দ্বেই ঘটছে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড।

২১ নভেম্বর লবণচরা থানার মধ্য হরিণটানায় আজাদ মেম্বারের বাড়ির সামনে রাজুকে টার্গেট করে পরপর ছয়টি গুলি চালানোর ঘটনা মাদক নিয়ে এই আধিপত্যযুদ্ধের সাম্প্রতিক উদাহরণ।

পুলিশ–র‌্যাবের অচলতা এবং নিরাপত্তাহীনতা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে।

পুলিশি অভিযান স্বাভাবিকভাবে চালানো যায়নি। র‌্যাবের কার্যক্রমও কমে যায় বলে অভিযোগ।এই সময়েই ছয় বাহিনীর তৎপরতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার ত.ম. রোকনুজ্জামান বলেন, “মাদকের আধিপত্য নিয়েই খুন–খারাপি বাড়ছে। সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এসব গ্রুপ আরও সক্রিয় হয়েছে।”

র‌্যাব–৬ অধিনায়ক লে. কর্নেল নিস্টার আহমেদও খুন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খুন–খারাপি একটি সামাজিক ব্যাধি, যা জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছাড়া একা প্রশাসনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার পরিস্থিতিঃ

খুলনায় সক্রিয় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ভীতিকর—

গ্রেনেড বাবু: ১৭ মামলা, নূর আজিম: ১৩ মামলা, আশিক: ৮ মামলা, পলাশ: ১৯ মামলা, হুমা: ৪ মামলা, আরমান: ৬ মামলা

জানুয়ারি মাসে পুলিশ শীর্ষ ১২ সন্ত্রাসীর নামে পুরস্কার ঘোষণা করলেও গ্রেনেড বাবু ও আশিক এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ইতিহাস বলছে—যৌথ বাহিনীর অভিযানেই শান্তি ফিরেছিল
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ও ২০০০–এর শুরুর দিকে খুলনা ছিল চরমপন্থীদের ঘাঁটি।
‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ ও ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’-এর মাধ্যমে র‌্যাব–পুলিশের যৌথ অভিযানে তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
বর্তমান অরাজক পরিস্থিতির কারণে নাগরিক সংগঠনগুলো আবারও বিশেষ অভিযান শুরুর দাবি তুলেছে।

নাগরিকদের আতঙ্ক চরমেঃ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় নগরবাসী বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছে। রাজনৈতিক দল বিএনপি করেছে প্রতিটি ওয়ার্ডে বিক্ষোভ।

আইন অধিকার বাস্তবায়ন ফোরামের মানববন্ধনের পরদিনই ঘটেছে আরও দুটি খুন।

অধিকাংশ নাগরিকের একটাই প্রশ্ন—
“কখন ফিরবে আমাদের নিরাপত্তা?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *