
|| ড. মো: জিল্লুর রহমান ||
বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কৃষিপণ্য বিপণনে একাধিক হাতবদল, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, পথে পথে চাঁদাবাজি, অতি মুনাফা, ইত্যাকার কারণে ভোক্তাগণ পণ্য ক্রয় ও ভোগে নাভিশ্বাসে রয়েছেন। উপরন্তু মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিবৃষ্টি কিম্বা খরা, বন্যা, ঝড়-ঝঞ্জা, পণ্য আমদানিতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, ইত্যাদি। এ চিত্র নতুন নয় বরং বছরের পর বছর বাজার সিন্ডিকেটের নব নব কৌশল ও বিরুপ পরিবেশ তা প্রকট থেকে প্রকটতর করছে। গত ১৬ অক্টোবর ভোক্তা অধিকার কর্তৃক বাজার তদারককালে দেখা গেল কৃষক পর্যায়ে ২০-২৫ টাকা মূল্যে বিক্রিত লাউ ঢাকা এসে ভোক্তা পর্যায়ে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ থেকে কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থায় যে কী তুঘলকী কান্ড ঘটে চলেছে তা প্রণিধানযোগ্য। শুধু লাউ নয় নিত্যপণ্যের সব ক্ষেত্রেই এ অরাজক অবস্থা বিদ্যমান। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার বাজার তদারকীতে প্রাণান্ত চেষ্টা স্বত্বেও তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি আর করার কিছু নেই?
গত ১৭ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ওএমএস এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রয় ও চাহিদা অনুযায়ী এর আওতা বাড়ানো একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। তবে, এভাবে শুধু ট্রাকে করে বিক্রি করে ভোক্তার বিপুল চাহিদা কতটুকু মেটানো যাবে তা বিবেচনার বিষয়। এক্ষেত্রে এটিকে স্থায়ীত্বশীল ও আরও কার্যকর করতে গেলে কৃষকের স্থায়ী বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে কৃষক যেমন উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে, তেমনি ভোক্তা স্বার্থও সংরক্ষিত হবে।
বিগত কয়েক দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কৃষকের প্রাপ্ত পণ্যমূল্য ও হাতবদলের পর ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ থাকা স্বত্বেও পূন:পূন: বেড়েই চলেছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার নানামূখী উদ্যোগ স্বত্বেও বাজারে স্বস্তিদায়ক স্থায়ীত্বশীল যৌক্তিক মূল্য মোটেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, এমনকি কোনো কোনো সময়ে বাজারমূল্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো সরকার গৃহীত এসব ব্যবস্থাদি অনেকটা তাৎক্ষণিক ও সাময়িক, তাই এর সুফল দীর্ঘমেয়াদী হয় না। অন্যদিকে এসকল ব্যবস্থাদি বাজার ব্যবস্থায় জড়িত ব্যবসায়ীদের জরিমানা, মামলা, আর্থিক ক্ষতি তথা স্বার্থহানী ঘটায় বিধায় তারা অনেক সময় ব্যবসা বন্ধ করে দেয়, আমদানি কমিয়ে দেয়, ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে এবং এর ফলশ্রতিতে দীর্ঘমেয়াদে পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব হয় না। তাই সরবরাহ চেইন খাটো করে কৃষক-ভোক্তা বিকল্প বাজার ব্যবস্থা চালুই অন্যতম একটি উপায় হতে পারে।
ঢাকাস্থ বিএডিসি অফিস প্রাঙ্গণসহ কিছু কিছু এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী কৃষকের বাজার অতীতে তেমন একটা ফলপ্রসু হয়নি যার অন্যতম কারণ হলো এসকল বাজার বিক্ষিপ্তভাবে অনেকটা অপ্রচলিত এলাকায় চালু হয়েছে। এখানে চাহিদামত সকল পণ্য যেমন পাওয়া যায় না, তেমনই সরবরাহ ব্যবস্থা স্থায়ীত্বশীল ও নিরবচ্ছিন্ন নয়। উল্লেখ্য যে, অতীতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক এনসিডিপি প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত কৃষি বাজারগুলো স্থানীয় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নীতির অভাবে কার্যকরভাবে পরিচালনাধীন রাখা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালযের এনএটিপি প্রকল্পের আওতায় চাষি/কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় প্রডিউসারস অর্গানাইজেশন (পিও) ও কৃষিপণ্য তথা কৃষি ফসল, মাছ, প্রাণিসম্পদ পণ্যের সরবরাহ চেইন উন্নয়নে কতিপয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উক্ত উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর একযোগে কাজ করলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন পরবর্তী এর স্থায়ীত্বশীলতা তেমন একটা লক্ষ্য করা যায়নি। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কৃষক/চাষি ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে এবং কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ পণ্যের বাজার ব্যবস্থা স্থায়ীত্বশীল ও যৌক্তিকীকরণে নিম্নরুপ পদক্ষেপ কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে।
পদক্ষেপ-১: কৃষকের বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও স্থায়ীত্বশীলকরণ
বর্তমানে প্রচলিত সিন্ডিকেট সর্বস্ব, মুনাফাখোরী বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে একটি ভোক্তাবান্ধব স্থায়ীত্বশীল বাজার ব্যবস্থাই কেবল এসব দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করে ভোক্তা স্বার্থ সরক্ষণ করতে পারে। বাজারে মোবাইল কোর্টসহ আইন প্রয়োগের চেয়েও বিকল্প বাজার ব্যবস্থা প্রচলিত বাজারকে ইাতবাচকভাবে প্রভাবিত করে সার্বিক বাজার ব্যবস্থাকে স্বস্তিদায়ক করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারকে কিছু ভর্তুকী প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও সহযোগীতা করতে হবে। একাজে নিম্নবর্ণিত কার্যাদি সম্পন্ন করা যেতে পারে-
প্রথমত: দেশের বিভিন্ন অঞ্চল তথা বগুড়ার মহাস্থান বাজার, রংপুরের শঠীবাড়ী ও সংলগ্ন বাজার, যশোর, রাজশাহীর পুটিয়া বাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঢাকার সাভার ও তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাইকারী বাজার যেখানে কৃষক বেশী পরিমাণে সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন, সেই বাজারগুলোকে পণ্য ক্রয়ের প্রাথমিক হাব হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এনসিডিপি প্রকল্পের আওতায় নির্মিত মার্কেটগুলো একাজে ব্যবহার করে প্রায় পরিত্যাক্ত এসকল স্থাপনার সদ্ব্যবহার সহ এতদসংক্রান্ত কৃষক/চাষি, উৎপাদক সংস্থা/সমিতি (প্রডিউসারস অরগানাইজেশন) সক্রিয় করে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও অর্জিত হবে। উল্লেখ্য যে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমাপ্ত এ্নএটিপি প্রকল্পেও প্রডিউসারস অরগানাইজেশন এর মাধ্যমে চাষি ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ পণ্যের সরবরাহ চেইন কার্যকর করার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তারও প্রতিফলন সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত: প্রতিটি বাজার থেকে একটি বিক্রেতা কৃষকের তালিকা তৈরী করতে হবে যারা ঢাকা কিম্বা দেশের চাহিদা সম্পন্ন অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে যৌক্তিক মুনাফায় নিজ দায়িত্বে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে আগ্রহী।
তৃতীয়ত: প্রাথমিক এসব ক্রয় হাবের পণ্য সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এর তদারকী ও সমন্বয়ে ঢাকাসহ দেশের চাহিদাসম্পন্ন বিভিন্ন ভোক্তা বাজারে বিক্রয়ের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষক/চাষি হারাহারিভাবে পরিবহন ভাড়া প্রদান করবেন। তবে, প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষকের বাজার ব্যবস্থা চালু করতে সরকার এ পরিবহনে উৎপাদনকারীগণের সংগে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভর্তুকী প্রদান করবেন যা বাজার ব্যবস্থা স্থায়ীত্বশীল ও কৃষকদের জন্য লাভজনক অবস্থায় পৌঁছলে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে। ভোক্তা বাজারে বিক্রয় ব্যবস্থাপনা ও ফিরতি ভ্রমন কৃষক নিজ দায়িত্বে ও খরচে সম্পন্ন করবেন। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় সড়ক, রেল, নৌপথ, প্রয়োজনে এয়ার কার্গো তথা একে সমন্বিত ও বহুমুখীকরণ করে পঁচনশীল পণ্যে আরও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চতৃর্থত: ঢাকাস্থ বিএডিসি অফিস প্রাঙ্গণে স্থাপিত কৃষকের বাজার এর আদলে চাহিদামত দেশের বিভিন্ন বড় বড় ভোক্তা বাজারের একটি অংশকে কৃষকের বাজার হিসেবে স্থাপন করতে হবে। এসকল বাজারে নির্বাচিত কৃষকগণ তাদের নিজ নিজ তত্বাবধানে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করবেন।
পঞ্চমত: কৃষক কর্তৃক সরাসরি পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ, উৎপাদন স্থলের স্থানীয় বাজারমূল্য, পরিবহন ব্যয়, আনুসাঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়, ইত্যাদি বিবেচনা করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সম্মিলিতভাবে পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিবেন।
ষষ্ঠত: এসকল বাজারে সরকার কিম্বা উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে চাহিদামত পর্যায়ক্রমে স্বল্পব্যয়ী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করবেন যাতে করে পচনশীল পণ্য পরবর্তীতে বিক্রয়ের জন্য সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে পিঁয়াজ, মরিচ, তরিতরকারীসহ অবিক্রিত অনেক পণ্যই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে একদিকে যেমন সম্পদের ক্ষতি হয়, অন্যদিকে এর পঁচনমূল্য পরবর্তী সরবরাহকৃত পণ্যে যুক্ত হয়, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি হয় ও মূল্য বাড়ে।
প্রস্তাবিত কৃষক বাজার ব্যবস্থা চালু ও স্থায়ীত্বশীল করতে প্রাথমিক অবস্থায় সরকারকে কিছু ভর্তুকী দিতে হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার প্রয়োজন হবে না। তবে এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিবিড় অংশগ্রহণ ও তদারকী প্রয়োজন হবে। মনে রাখতে হবে সরকারের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা বিআরটিসি এর মত প্রতিটি ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনভাবেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে না এবং এ ব্যবস্থার প্রভাব প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে কল্যাণমূখী, স্থিতিশীল, যৌক্তিক ও ভোক্তাবান্ধব করবে।
পদক্ষেপ-২: সংকট নিরসনে টিসিবি’র মাধ্যমে পণ্যক্রয় ও সুলভ মূল্যে ওএমএস পরিচালনা
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষণীয় যে, কমবেশী প্রতি বছরই কিছু কিছু সময়ে পণ্যের সংকট হয়ে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে মূল্য বেড়ে যায়। বিগত কয়েক বছরের বাজারের এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঘাটতি পণ্যের প্রকার ও পরিমাণ আগাম নির্ধারণ করতে হবে এবং বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহে আনেক আগে থেকেই ক্রয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে রাখতে হবে, শুধুমাত্র কার্যাদেশ দেয়ার অপেক্ষায় থাকবে। এভাবে বাজারে পণ্যের সংকটকালে তড়িৎ কার্যাদেশ দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য সংগ্রহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, কোন কোন সময় সংকটকালে কিম্বা দেরীতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এ কার্যক্রম কাঙ্খিত সুফল বয়ে আনে না।
পদক্ষেপ-৩: সংকট নিরসনে আমদানিতব্য পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাসকরণ
দ্রুততার সাথে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দরকারি নিত্যপণ্য আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি ও সুলভ মূল্য নিশ্চিতকরণে সংকটাপন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক হ্রাস বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর কৌশল। এ বিষয়ে টিসিবি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থকে উদ্যোগী হয়ে বর্তমান ব্যবস্থাকে জোরদার করে শুল্ক হ্রাস, আমদানিতব্য পণ্যের প্রকার, পরিমান, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি যথাসময়ে গ্রহণ করতে হবে।
পদক্ষেপ-৪: সংকট নিরসনে বাজার তদারকী
মজুদদারী, সিন্ডিকেট কান্ড, অতি মুনাফা, কৃত্রিম সরবরাহ সংকট, পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি, ইত্যাদি অনৈতিক ও অব্যবসাসুলভ কর্মকান্ড রোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপনন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক বাজার নজরদারী/পরিবীক্ষণ আরও জোরদার করতে হবে। উৎপাদন খরচ, পরিবহন, বাজারজাতকরণে শ্রমিক মজুরী, ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে পণ্যের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে ও তা নিয়মিত নজরদারী/পরিবীক্ষণ করতে হবে। এসবের ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজার সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের খুঁজে বেড় করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।
পদক্ষেপ-৫: পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে চাঁদাবাজি প্রতিরোধকরণ
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হলো পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বিভিন্ন মোকাম, রাস্তা, ঘাটে, বাজারে অসহনীয় চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজি রোধে আইন প্রয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার জাতীয় হট লাইন ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে। পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা যাতে স্বপ্রণোদিত হয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এবিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
পদক্ষেপ-৬: সম্ভাব্য সংকটাপন্ন পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি
অতীত অভিজ্ঞতা ও বিগত কয়েক বছরের বাজারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঘাটতি পণ্যের প্রকার ও পরিমাণ আগাম নিরুপনপূর্বক প্রতি উৎপাদন মৌসুমে সংকটাপন্ন পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে এসকল কৃষিজ নিত্যপণ্যে দেশকে সয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে।
পদক্ষেপ-৭: পণ্যের পচনরোধ ও অন্তবর্তী কালে সাময়িক মজুদের জন্য স্বল্পব্যয়ী হিমাগার ব্যবস্থা
পচনশীল কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে অনেকসময় পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়, তাছাড়া পণ্য বাজারে পৌঁছানোর পর কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন সাময়িক মজুদেরও প্রয়োজন হতে পারে। পণ্য পঁচে গেলে ও সংরক্ষণ করা না গেলে অপচয় হয় এবং এমূল্য প্রকারন্তে পরবর্তী বিক্রয়তব্য পণ্যে সংযোজিত হয়ে বাজারমূল্য বৃদ্ধি করে এবং পণ্যের ঘাটতিও বেড়ে যায়। এসকল কারণে পচনশীল কৃষিজ নিত্যপণ্য সংগ্রহ/ক্রয় হাব ও ভোক্তা বাজারে পণ্যের সাময়িক মজুদের জন্য স্বল্পব্যায়ী হিমাগার ব্যবস্থা থাকা একান্ত আবশ্যক। সরকারি ব্যয়ে/উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কিম্বা ভাড়া ভিত্তিতে এধরণের হিমাগারে এর ব্যবসাথা করা যেতে পারে। স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থার জন্য এ ধরণের হিমাগার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
পদক্ষেপ-৮: ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, খাদ্য নিরাপদতা, বিএসটিআই সহ সংশ্লিষ্ট আইন-বিধির ব্যাপক প্রচারণা
পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করে বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়ন ও আইন প্রয়োগ সহজতর করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, খাদ্য নিরাপদতা, বিএসটিআই এর বিধি-বিধান সহ সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি সম্পর্কে অংশীজনের সম্যক ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এবিষয়ে লিফলেট, বুকলেট বিতরণ, টিভি ফিলার, মাইকিং, সচেতনতা সভা, ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদারকরণ ফলপ্রসু হবে। উল্লেখ্য যে, পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীগণ অনেক সময় ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ/ক্যাশ মেমো রাখেন না কিম্বা স্বচ্ছতার সাথে ঐসকল কার্য সম্পাদন করেন না, ফলে যথাযথ বাজার মনিটরিং সম্ভব হয় না।
পদক্ষেপ-৯: বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারকরণ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্প্রতি গঠিত বাজার মনিটরিং কার্যক্রম কমিটির কার্যপরিধি অনুযায়ী জোদারকরণ ভাল সুফল বয়ে আনতে পারে। অনেক সময় অতি কঠোর বাজার মনিটরিং এর কারণে ব্যবসায়ীগণ দোকান/ব্যবসা বন্ধ রাখেন, পণ্য আমদানি করেন না কিম্বা কমিয়ে দেন ও সরকারকে অসহযোগীতা করেন। এসব বিষয়ে বাজার মনিটরিং এর জন্য কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, সাবেক উপপরিচালক ও পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
খুবই চমৎকার প্রস্তাবনা। বাস্তবায়ন হলে কৃষক-ভোক্তার স্বস্তি মিলবে।
অসাধারণ আলোচনা। প্রতিফলিত হলে পৌষমাস থেকে সিন্ডিকেটের সর্বনাশ হবে।
বাস্তবায়ন কি হবে? হলে তো পৌষমাস থেকে সিন্ডিকেটের সর্বনাশ হবে।