সোমবার, মার্চ ১৭

মাদ্রাসার আরবি বিষয়সমূহের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মান বণ্টন যেরকম হতে পারে!

|| আব্দুর রহিম ||

সারাদেশে মাত্র তিনটি আলিয়া মাদ্রাসা সরকারি। বাকি সব মাদ্রাসাই বেসরকারি। প্রতি বছর জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দুই-চারটি স্কুল ও কলেজ সরকারি হচ্ছে।দুঃখের বিষয় একটি মাদ্রাসাও সরকারি হচ্ছে না।৫ আগস্টের পর অনেকে মনে করেছিলেন এই বৈষম্য দূর হবে। কিন্তু সেরকম কিছুই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মাদ্রাসা শিক্ষা ও আলেম সমাজের কোনো অবদান নেই! বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ দেয় “বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)”। এনটিআরসিএর বর্তমান শিক্ষক বা প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধ নিয়োগের পথ বন্ধ হয়েছে ঠিক, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক বা প্রভাষক নিয়োগ হচ্ছে কিনা সেটা বিবেচনা করা দরকার। আরবি, কোরআন, হাদিস এবং ফিকাহ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান যে প্রক্রিয়া আছে তাতে এসব বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি যোগ্য প্রার্থীদের আসার সুযোগ একেবারেই কমে গেছে। ফলে মাদ্রাসাগুলো শিক্ষার্থীদেরকে আরবি ও কোরআন-হাদিসে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা দিতে পারছে না বলেও অনেক অভিভাবক মাদ্রাসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আরবি ও কোরআন-হাদিসের যথাযথ শিক্ষাই যদি মাদ্রাসা থেকে না পাওয়া যায় তাহলে তারা কেনো তাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন?

এনটিআরসিএ-এর নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো ওই প্রার্থীকে নিবন্ধিত হতে হবে। আর নিবন্ধিত হতে হলে তাঁকে বিসিএসের আদলে তিন ধাপে পরীক্ষা দিতে হবে। প্রথম ধাপে (প্রিলিমিনারি) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কে (যে বিষয়ের তিনি শিক্ষক হবেন) বেশি যোগ্য, কে যোগ্য নয় তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। আরবি, কোরআন-হাদিস বিষয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছেন তাঁদের প্রিলিমিনারিতে আরবি বিষয়ক কোনো প্রশ্ন নেই। তাঁদেরও প্রিলিমিনারি পরীক্ষার বিষয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হলে তবেই দ্বিতীয় পর্বে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের (যে বিষয়ের তিনি শিক্ষক হতে চান) মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যাবে। আর মূল লিখিত পরীক্ষায় আরবির শিক্ষককে আরবির জন্য পরীক্ষা দিতে হবে, ইংরেজির জন্য দিতে হবে ইংরেজির পরীক্ষা। কিন্তু আরবিতে খুব দক্ষ একজন প্রার্থীও ইংরেজি বা গণিতে দুর্বল হলে প্রিলিমিনারিতে আটকে যাওয়ায় কিছুতেই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে আরবিতে খুব দক্ষ একজন প্রার্থীও মূল লিখিত পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়ছেন। আবার তাঁর চেয়ে আরবিতে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য লোকটিও বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে দক্ষ হওয়ায় মূল বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। মূল বিষয়ের পরীক্ষায় সর্বাধিক যোগ্য লোকটি আসতে না পারায় প্রতিযোগিতাটি হচ্ছে তুলনামূলক দুর্বলদের মধ্যে।

আরবিতে সর্বাধিক যোগ্য লোকটি প্রিলিমিনারিতে ছাঁটাই হয়ে গেলেন। অথচ শিক্ষক নেয়া হবে আরবির জন্য! যাঁরা বাংলা, ইংরেজি বা গণিতের শিক্ষক হবেন, তাঁদের জন্য প্রিলিমিনারির এ প্রক্রিয়া হয়তো ঠিক আছে, তাঁদের ওই বিষয়ের প্রশ্ন এখানে আছে, কিন্তু আরবির শিক্ষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি বহাল থাকলে আরবিতে সবচেয়ে ভালো লোকটি আসতে পারবেন না শিক্ষকতায়। মাদ্রাসাগুলো বঞ্চিত হবে ভালো মানের আরবি শিক্ষক থেকে। এ পদে শিক্ষক কি ইংরেজি বা গণিতের জন্য নেয়া হচ্ছে নাকি আরবির জন্য? ক্লাসে কি তাঁকে আরবির যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, নাকি ইংরেজির? আরবির যোগ্যতা না থাকলে বেসিক ইংরেজি বা গণিত জেনে তিনি কী করবেন? তাঁর পাঠদানের বিষয় তো আরবি। ইংরেজির জন্য তো আলাদা শিক্ষক আছে।

এনটিআরসিএ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এনেছে তো ক্লাসরুমে সর্বাধিক যোগ্য শিক্ষক দেয়ার জন্য। নিবন্ধন পরীক্ষার পদ্ধতিতে এ সমস্যার কারণে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে সর্বাধিক যোগ্যরা শিক্ষক হিসেবে আসতে পারছেন না। এনটিআরসিএকে এ ব্যাপারে ভাবতেই হবে। নয়তো আরবি বিষয়ে এমন শিক্ষক আসবেন, যাঁরা আরবির শুদ্ধ উচ্চারণও করতে পারেন না।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষার চারটি বিষয়ের (বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান) যেকোনো একটির বিকল্প হিসেবে আরবি বা ইসলামিক স্টাডিজ নেয়ার সুযোগ রাখা হলে প্রিলিমিনারিতে আরবিতে দক্ষরা উত্তীর্ণ হতে পারবেন। অর্থাৎ কেউ চাইলে গণিতের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারায় আরবির যোগ্যতাটাও সেখানে প্রমাণের সুযোগ থাকবে। এক্ষেত্রে প্রিলি পরীক্ষার নম্বর বণ্টন এইভাবে হতে পারে:
১.বাংলা -২৫
২.ইংরেজি -২৫
৩.গণিত -২৫
৪.আরবি গ্রামার ২০+ কুরআন, হাদিস, ফিকাহ্ ৫=২৫
অথবা
১.বাংলা -২০
২.ইংরেজি -২০
৩.আরবি-২০
৪.সাধারণ জ্ঞান -২০
৫.গণিত-২০
অথবা
১.বাংলা -২০
২.ইংরেজি -২০
৩.গণিত -১০
৪.কুরআন -১৫
৫.হাদিস ও ফিকহ -১৫
৬.আরবি -২০

নিবন্ধন লিখিত পরীক্ষায় :
আরবি গ্রামার ৪০% অথবা আরবি সাহিত্য ১৫+ আরবি গ্রামার ৩৫= ৫০
কুরআন: ২০+ হাদিস: ২০ ও ফিকাহ্ +১০=৫০।

ফলে আরবিতে বেশি যোগ্য একজন কোনো কারণে গণিতে কিছুটা দুর্বল হলেও তাঁর মূল বিষয়ের যোগ্যতায় তিনি লিখিত অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। মাদরাসাগুলো ভালো মানের আরবি শিক্ষক পাবে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর আরবির চাহিদা পূরণ হবে। মধ্যপ্রাচ্যের কর্মের বাজারে প্রতিযোগিতা করে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারবেন তো তখনই যদি তাদের শিক্ষক হন আরবিতে পারদর্শী।

অনেকে মনে করছেন যে, প্রিলি পরীক্ষায় বর্তমানে যে পদ্ধতি রয়েছে সেটাই বেটার। কারণ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রিলি প্রশ্ন ( বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞান) মাধ্যমিক স্তর (দাখিল) থেকে করা হয়। বর্তমানে স্কুল ও মাদ্রাসার জেনারেল সাবজেক্টগুলোর বই অভিন্ন। তাই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যদি মাধ্যমিক স্তরে ভালো করে পড়াশোনা করেন তাহলে প্রিলিতে আরবি ছাড়াই পাশ করতে সক্ষম।

তবে এনটিআরসিএ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। তাই এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে পিএসসির ন্যায় স্বতন্ত্র “শিক্ষক নিয়োগ কমিশন” গঠন করা দরকার। কারণ বাংলাদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা এই দুইটি সেবা খাতে সবচেয়ে বেশি জনবল নিয়োগ হয়। অথচ এই দুইটি বিভাগ অন্যান্য সেক্টরের সাথে যুক্ত থাকায় জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এই দুইটা সেক্টর জনগণের মৌলিক অধিকার। একটা কল্যাণ রাষ্ট কীভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করতে পারে? রোগীরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গিয়ে দেখে ডাক্তার নেই। কবে বিসিএস সার্কুলার হবে আর কবে নিয়োগ পাবে? ততোদিনে কী রোগী জীবিত থাকবে?

শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখে প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষক নেই! তাহলে তারা কীভাবে শিখবে?নকল কীভাবে বন্ধ হবে?
সবচেয়ে বেশি জনবল নিয়োগের প্রয়োজন হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেটা যদি পিএসসি বা এনটিআরসিএ -এর মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে কমপক্ষে পিএসসি সময় নিবে ৩ বছর থেকে ৪ বছর আর এনটিআরসিএ সময় নিবে ২ থেকে ৩ বছর। একটা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ শূন্য হওয়ার পর যদি সেই পদে শিক্ষক পেতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় নেয়! তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান কোন অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ায়? এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে নাকি হ্রাস পাবে?
কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গেস্ট টিচার দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবুও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গেস্ট টিচার নেওয়ার সক্ষমতা নেই।কাজেই
এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে এবং সরকারি স্কুল ও কলেজে নিয়োগের দায়িত্ব পিএসসি অধীনে না নিয়ে “স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন ” করে সরকারি এবং বেসরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব অর্পণ করলে অনেকটা সময় কম নিবে এবং কাজে গতি আসবে। এই শিক্ষা ক্যাডারদের পদোন্নতি হবে (আন্তঃমন্ত্রণালয়ের) শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে।

লেখক: শিক্ষক, সৈয়দ আব্দুল মান্নান ডি.ডি. এফ আলিম মাদ্রাসা, বরিশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *