বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯

একটি রাষ্ট্র শিক্ষকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য

শিক্ষকতা মহান পেশা সেকথা কে না জানে? কিন্তু যার পেটে ভাত নেই তাকে এই নীতিকথা শুনিয়ে কী লাভ? একজন শিক্ষক হলো একটা আদর্শ জাতি গঠনের কারিগর। আর এই আদর্শ জাতি গঠনের একক দায়িত্ব শুধু শিক্ষকদের নয়।রয়েছে পরিবার ও রাষ্ট্রের। এখন একজন শিক্ষক চিন্তা করে কীভাবে একজন আদর্শ নাগরিক গঠন করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো রাষ্ট্র এই শিক্ষকদের নিয়ে মোটেও চিন্তা ভাবনা করে না।

এমনকি এই শিক্ষকরা যাদেরকে পড়াশোনা করিয়েছেন, তারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তারাও তার সেই শিক্ষককে ভুলে যায়। অহংকারী হয়ে শিক্ষককে সম্মান ও তাঁর অধিকারটুকু দিতে নারাজ। তাই মাঝে মাঝে আফসোস করে শিক্ষকরা নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন, কাকে এতোদিন মানুষ করলাম। সে সারাজীবন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে এখন সরকারি জব নিয়ে সরকারি অংশের পরিবর্তে বলে অনুদান!

সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় কম। তাই অনেক যোগ্য প্রার্থীও লোকবল কম নেওয়ায় বাদ পরে যায়। তার মানে তারা সবাই অযোগ্য বলে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বিষয়টা এরকম নয়। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে
অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যারা তাদের চাইতে বিষয় জ্ঞানে অনেক এগিয়ে।

তাই একটা রাষ্ট্রের অবশ্যই শিক্ষা ও শিক্ষকদেরকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আগে শিক্ষকদেরকে স্মার্ট সুবিধা দিতে হবে। কারণ স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মূল কারখানা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অন্যরা যে কাজ করেন, শিক্ষকরা তাদের চাইতে অনেক কঠিন ও ভিন্ন কাজ করেন। কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কাজের দক্ষতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই পায় একজন শিশু। শিক্ষক পরিশ্রম করে যা তৈরি করে, অন্য সবাই তার ফল ভোগ করে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে:

১. মানসম্মত বেতন-ভাতা :
একজন শিক্ষকে যদি ক্লাসে গিয়ে ভাবতে হয় তার ঘরে চাল নেই। সন্তান অসুস্থ পকেটে টাকা নেই।ঘরে বাজার নেই, মাস শেষ বাসা ভাড়া দিতে হবে। এই যদি হয় শিক্ষকের অবস্থা তাহলে সে কী পড়াবে? কী পাঠ পরিকল্পনা করবে?

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো একটা ইফেক্টিব ক্লাস নিতে হলে সবার আগে একটা টেনশন মুক্ত মাথা প্রয়োজন। আমার রাষ্ট্র কী আমাকে একটা টেনশন মুক্ত মাথা দিতে পেরেছে?

সরকার বেশি বেতন দেয় একজন ব্যাংকারকে। যার ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা বাদ দিয়ে ব্যাংকে চলে যায়। একজন শিক্ষককে বেশি বেতন দিলে সে টাকা সে নিজ দেশেই খরচ করবে। কখনো বাহিরে টাকা পাচার করবে না

২. বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা :
বর্তমানে মানসম্মত একটা বাসা সাড়ে চার-তিন হাজারের কমে পাওয়া যায় না। এক হাজার টাকার কম একজন ডাক্তারের ভিজিট নেই। সরকার এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাঁচশত টাকা চিকিৎসা ভাতা দেয়, তাতে কোনো ডাক্তারকে দেখানো যায় না।

আমি বলি যদি এরকমই চলে তাহলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য কোয়াটারের ব্যবস্থা করুন।মাসে এক হাজার টাকা করে সরকারকে ভাড়া দিবো। আর সরকারি হাসপাতালে ডক্টর দেখানোর জন্য কার্ড করে দিক।

৩. অটো-এমপিও :
একজন শিক্ষককে পড়াশোনা করে জব নিয়ে যতোটা কষ্ট হয় তার চাইতে বেশি কষ্ট হয় এমপিওভুক্ত হতে! চল্লিশ প্রকারের কাগজ সাবমিট করা লাগে! এমন কি! কাবিননামাও!
শিক্ষা অধিদপ্তর ও ব্যানবেইজে সেই তথ্যগুলো কী নেই? যদি না থাকে তাহলে আমরা কী ডিজিটাল হলাম।

একজন প্রার্থীর সকল ডাটা ও প্রতিষ্ঠানের ডাটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে রয়েছে। যদি না থাকে তাহলে এতো টাকা খরচ করে ওয়েবসাইট তৈরি করার দরকার কী? বা প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইট তৈরি করার কথা যে বলেছে সেই নির্দেশ পালন না করে থাকে কীভাবে?

৪. বদলি :
বর্তমানে যেহেতু এনটিআরসি এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তাই অনেকেই তার নিজ এলাকার বাহিরে জব করেন। তার বেতন বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যা দেয়, তাতে দিন চলে না।

বদলি সুবিধা না থাকায় তারা নিজ এলাকায় আসতেও পারে না। আবার অনেক এলাকা নদী বেষ্টিত হওয়ার কারণে সেখানে কেউ যেতে চায় না। ফলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট থেকে যায়। যদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেন, তাহলে কাউকে যদি বলা হয় যে তোমাকে আফ্রিকার জঙ্গলে যেতে হবে, তখন সবাই রাজি হবে।

৫. ইএফটির মাধ্যমে বেতন প্রদান :
আমরা নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস করি?!!!এখনো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতনভাতা এনালগ সিস্টেমে দেওয়া হয়। কেনো? চোরদের ধরার জন্য নাকি অন্য কোনো সমস্যা? সব চোর কী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? সরকারিতে নেই? একটা দেশে দুই নীতি ও দুই দৃষ্টিভঙ্গি (সরকারি বনাম বেসরকারি) এইভাবে ট্রিট করলে কখনো কল্যাণকর রাষ্ট্র ও আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব না। একজন শিক্ষক বিলে স্বাক্ষর করার জন্য বরিশাল থেকে সিলেট যাবে?!!

৬. পদোন্নতি :
একজন শিক্ষক সে যতোই পরিশ্রম ও ডিগ্রি অর্জন করুক না কেনো, তার বেতন ঐ একই থাকে। আর যে কিছুই করে না, তারও বারো হাজার পাঁচশত টাকা। তাহলে অন্যজন কেনো বেশি পরিশ্রম করবে? তার কাজের স্বীকৃতি কোথায়?

৭. পেনশন সুবিধা :
পেনশন সুবিধা যদি অন্য শিক্ষকদেরকে দেওয়া হয় তাহলে এদেরকে কেনো দেওয়া হবে না? সংবিধানের কোথায় এরকম ধারা রয়েছে? তাহলে রাষ্ট্র কী নিজেই সংবিধান মানে না? আপনি একজনকে দিয়ে অন্যদের মতো সমান বই ও সমান পরিশ্রম করাবেন। আর দেওয়ার বেলায় তুমি এমপিওভুক্ত? তাহলে এখানে ভালো কেউ আসতো না, আসলেও থাকবে না। কারণ আপনি রাষ্ট্রইতো তাকে সম্মান দিলেন না, অবমূল্যায়ন করলেন।

৮. শতভাগ উৎসব ভাতা :
কী সুন্দর থিওরি! উৎসব ভাতা দিবেন ২৫% আর আনন্দ করবেন ১০০%। একজন দোকানদার কী তার পণ্যের মূল্য ২৫% হিসেবে নিবে?

যখনই রাষ্ট্রকে বলা হয় আপনার শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে বেশি বরাদ্দ দিবেন। তখনই রাষ্ট্র ফকির হয়ে যায়! বলে গবেষণা করতে হবে! আর অন্য সকল ক্ষেত্রে দেওয়ার সময় দেউলিয়া হয় না আর গবেষণারও প্রয়োজন হয় না।

তাই রাষ্ট্র যেমন শিক্ষকরাও তেমন! পড়াশোনাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমন। পরীক্ষায় নকলের সয়লাব। বিষয়টা এরকম ইমামের বেতনও নেই; নামাজও সে নিয়মিত অযু ছাড়া পড়ায়!

৯. জাতীয়করণ :
হাজার হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হলো কী বিবেচনা ও গবেষণা করে।
আর এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার কথা বললে বলে “গবেষণা করে দেখতে হবে। জাতীয়করণ করলে শিক্ষার মান বাড়ে না কমে”! যদি জাতীয়করণ করলে শিক্ষার মান কমে, তাহলে এই সরকারের আমলে কতগুলো প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলো। সেগুলো কেনো করলো? আর রাষ্ট্রের সক্ষমতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানের আয় নিন। প্রতিষ্ঠানের আয় তো প্রধান শিক্ষক ও কমিটির পেটে!শিক্ষকের পেটে লাথি!

পরিশেষে বলি, যারা আগে কমিটিকে টাকা দিয়ে জব নিয়েছে। তারা জাতীয়করণ, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎস ভাতা, বদলি চালু, অটো-এমপিও এবং ইএফটির মাধ্যমে বেতন এই সব বিষয় নিয়ে দাবি আদায়ের আন্দোলনে কখনো শরীক হবে না। কারণ, তারা অসদুপায়ে এই জব পেয়েছে। তাদের কাছে এই জবের মূল্য কম।

তাই যারা পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে এসেছেন। তারা সবাই একজোট হই।
আমাদের দাবায় রাখতে পারবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *