বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯

উন্নয়নে নীরব অংশীদার রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র

অনেকটা বিরোধীতার মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণঞ্চলের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি। রাজনীতির বেড়াজালে পড়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকটা জটিল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল যাকে অনেকটা অতিক্রম করে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি আলোরমুখ দেখে।

বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার রামপালে অবস্থিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। রামপালে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB) ১৩২০ মেগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প এটি। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে পশুর নদী ঘেঁষে এই প্রকল্পের ১৮৩৪ একর জমির সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১০ সালে জমি অধিগ্রহণ করে বালু ভরাটের মাধ্যমে এই বৃহৎকর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৯ জানুয়ারী ২০১২ তারিখে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এনটিপিসির সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যৌথ উদ্যোগের এই কোম্পানিটি বাংলাদেশ ভারত ফেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআই এফপিসি) নামে পরিচিত। বিপিডিবি এবং এনটিপিসি ৫০:৫০ ইকুইটি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দিন রাত কাজ করে চলেছে। এনটিপিসি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন এবং পরিচালনা করছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তারা উচ্চমানের কয়লা আমদানি করে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি তৈরি করেছে পরিবেশ রক্ষায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সুন্দরবনের উপর প্রভাব নগণ্য পর্যায়ে রাখার জন্য অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে কর্মস্থানের দিকে নিয়মিত লক্ষ্য রাখা হচ্ছে যা স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনেতিক সমৃদ্ধি আনয়নে সযোগিতা করছে। একটি এলাকায় যখন কোন বিনিয়োগ হয়, তখন তার সুফল ঐ এলাকার সাধারণ মানুষ ভোগ করে থাকে, যেমন আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস শিল্প। যেখানে এই ফ্যাক্টারী রয়েছে তার আশে পাশে ছোট খাট বাজার গড়ে উঠে বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের আয়েযযযর উৎস তৈরী হয়ে থাকে। কর্মসংস্থান তৈরী হয় সাধারণ মানুষের। স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থাননের সুবিধা এবং নারী ও সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কার্যক্রমও বেশ ভালোভাবে করে যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজের সময় লক্ষাধিক শ্রমিকের একটি দল নিযুক্ত ছিল এবং এই প্রকল্পের সাথে জড়িত বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসি) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলি এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিভিন্ন সময়ে এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত জনবল পরিবর্তিত হয়েছে। তবে ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে আনুমানিক ৬,০০০ এরও বেশি শ্রমিক কাজ করার কথা বলা হয়েছে। তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি কয়লা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩২০ মেগাওয়াট। এই কর্মযজ্ঞের অংশীদার প্রতিষ্ঠান National Thermal Power Corporation—এর বাংলা অর্থ হলো- জাতীয় তাপ বিদ্যুৎ কর্পোরেশন। এটি ভারতীয় সরকারি খাতের সংস্থা, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে নিয়োজিত। এটি কোম্পানী আইন ১৯৫৬ এর অধীনে অন্তভূর্ক্ত এবং ভারত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সংস্থার সদর দপ্তর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত। শ্রী গুরদীপ সিং এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নীরব ভূমিকায় রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ করে চলেছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২৪ সালের মার্চ মাসে। বর্তমানে বিদ্যুকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট থেকে সক্ষমতার সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা হচ্ছে। রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের হিসাব খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, চলতি বছরে জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্জন করেছে ৬৭৬.৭৩ মিলিয়ন ইউনিট। কেন্দ্রটির ইউনিট—২ থেকে ১জুন সর্বোচ্চ দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হার ১০০.৩ শতাংশ রেকর্ড করেছে। ইউনিট —১ থেকে গত গত ১৫ জুন সর্বোচ্চ দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হার ১০০.৪৬ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে। ইউনিট —১ থেকে গত এপ্রিলে মাসিক সর্বোচ্চ কেন্দ্রের কার্যক্ষমতার হার ৯৯.৯৬ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। গত জুনে সর্বোচ্চ মাসিক কার্যক্ষমতার হার ৯৭.২৮ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসের (কিউ৪) সর্বোচ্চ স্টেশন ডিসি ৯২.২ শতাংশ। এই আর্থিক বছরের জন্য স্টেশন ডিসিটি গত ১২ এপ্রিল সম্পন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে, জাতীয় গ্রীডে প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে শিল্পায়নে অবদান রাখছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। দেশের জাতীয় গ্রিডে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ যোগ করছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকেও গতিশীল করছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট থেকে দিনের বেলা ৪০০ থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চাহিদা থাকে ৬০০ থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট। গত ১ জুন ও ১৫ জুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট আলাদা আলাদা করে সক্ষমতা শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অনেকে মনে করেন কয়লার অভাবে অনেক সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে না। তবে বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎতের চাহিদা কম থাকায় অনেক সময় একটি কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আগামীতে ঝুঁকি এড়াতে কয়লার মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে মজুদ সক্ষমতা বাড়িয়ে সবসময় চার থেকে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক সময় কয়লা ক্রয়ের মূর্য বকেয়া থাকে, কিন্তু এটা স্বাভাবিক। তারপরও কতৃর্পক্ষ নিজেদের দক্ষতার বলে কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে যেন কোন বাঁধা না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। কারণ দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ১৭০০ মিরিয়ন ঘনফুটে নেমেছে বাড়তি এল এন জি আমদানি করেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দৈনিক ঘাটতি ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সরবরাহ নিয়মিত না থাকলে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। উৎপাদন না হলে উন্নয়ন ব্যহত হবে। সকল সময় দেশের কথা ভেবে কথা বলা তৈরী পোশাক রপ্তানীকারকদের মুখপাত্র বিজিএমইএ’র দাবি, শিল্পে দ্রুত গ্রাস সংকট নিরসন না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের এই প্রধান রপ্তানি শিল্প।

বাস্তবতা হচ্ছে চার বছর আগেও দেশীয় কূপগুলো থেকে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন হতো গড়ে দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজা ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে সেটি নেমে এসেছে একহাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এতে শিল্প কারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আবাসিকসহ সবক্ষেত্রে চলছে গ্যাস সংকট। বিকল্প মাধ্যম ব্যবহার ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নাই। পরিবেশ রক্ষা অবশ্যই করতে হবে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি উন্নয়নের কথা আমাদের ভাবতে হবে। রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টির দিকে নজর প্রদান করা হচ্ছে স্বচ্ছভাবে। একটি কথা ভাবতে হবে শিল্প খাত না বাঁচলে থেমে যাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি স্তবির হয়ে পড়বে।

বিনিয়োগ থমকে থাকায় দেশে কিন্তু কর্মসংস্থান দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাংলাদেশে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ৩৫.২ বিলিয়ন থেকে ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন যা খুব কঠিন।

আধুনিক জীবনপ্রবাহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে বিদ্যুৎ। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য বিদ্যুৎ প্রবাহের নিশ্চয়তার বিকল্প নেই। আমাদের জাতীয় গ্রীডে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে তার একটি অংশ আসে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। অর্থনীতির চাকাকে নীরবে সচল রাখার কাজটি করে চলেছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জাতীয় গ্রীডে প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ যুক্ত করে নীরবে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। আমাদের দেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৭ থেকে ৮ শতাংশই আসছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবার পরবর্তী পর্যায়ে এলাকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবার ফলে জীবন ধারণের মানের পরিবর্তন হয়েছে। শীতে শীতবস্ত্র বিতরণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে যুক্ত রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কতৃর্পক্ষ। কমিউনিটির সাথে নিজেকে জড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ভূমিকা রাখছে নীরবে সেটি নিয়ে আমাদের সকলকে ভাবতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *