|| প্রফেসর ড. মো: ময়নুল হক, ইবি ||
যায়নবাদ ইহুদী রাজনৈতিক চেতনার নাম। ইংরেজীতে বলা হয়- Zionism, হিব্রু ও আরবীতে বলা হয় ছহিইয়ুনিয়্যাহ। আল-কুদস শহরে অবস্থিত ছহিইয়ুন পাহাড় এর সাথে সম্পর্কিত করে ইহুদীদের রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করা হয়েছে- ছহিইয়ুনিয়্যাহ। তাদের দাবী অনুযায়ী দাউদ (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ছহিইয়ুনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল (খ্রি.পূর্ব ৯৬০-১০০০)। দার্শনিক বারনাবাম ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে হারকাতু আহিব্বা ছহিইয়ুন (ছহিইয়ুনকে যারা ভালোবাসেন তাদের আন্দোলন) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে যায়নবাদীদের (ছহায়েনাহ) প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বহুদিন ধরেই মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ইহুদী জাতি গোষ্ঠী নির্যাতিত হচ্ছিল, তাদেরকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছিল। ঐসব দেশের সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল- ইহুদী বিশ্বাসঘাতক জাতি। যার খায় পরে তাকেই গলাটিপে হত্যা করে। দেশ ও জাতির ক্ষতি করা ছাড়া তাদের থেকে কিছুই আশা করা যায় না। পরবর্তীকালে হিটলারও একই কারণে লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন।
আজকের আরব বিশ্ব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ইহুদী জাতি কতটা নিমকহারাম। যা হোক, ইউরোপে ঘটে যাওয়া উপর্যুক্ত কারণেই ইহুদীরা নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক সংগঠন ছহিইয়ুনিয়্যাহ বা যায়নবাদ। আর ইহুদীদেরকে তারা আহবান করে বাপ-দাদাদের ভিটেভূমি ফিলিস্তিনে হিজরত করার। কারণ ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, দাউদ, সুলাইমান (আ.) এর পুন্যভূমি ফিলিস্তিন। আর তাদের দাবী অনুযায়ি এরা সবাই ইহুদী ছিলেন। যদিও আল-কুরআন স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে এরা কেউই ইহুদী ছিলেন না, এরা সবাই ছিলেন দ্বীনে হানিফের এর উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলমান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর ফিলিস্তিন কব্জা করে বৃটেন এবং বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায় ইহুদীরা। ১৯১৭ সনের ২ নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর বৃটেনের জায়নবাদীদের লিডারের নিকট পত্রের মাধ্যমে জানায় প্যালেস্টাইনে (national home for the Jewish people) ইহুদীদের জন্যে জাতীয় ভূমি দেয়া হবে এবং তা ৯ নভেম্বর বৃটেনের “দি টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জমির মালিক কে, আর দান করে কে।
নজদের গোত্রপতি আব্দুল আজিজ বিন আলে সউদ সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা করেন বৃটিশদের সহযোগিতায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এবং প্রথম বারের মতো তারা হিজাজ অঞ্চল তথা মক্কা-মদীনার কর্তৃত্ব লাভ করেন। বৃটিশ সহায়তার বিনিময়ে আলে সউদ পরিবার বিক্রি করে দেয় ফিলিস্তিন, যা মিসকিন ইহুদীদেরকে দান করে বৃটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাতিসংঘ গঠিত হলে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের ৪৮ শতাংশ ভূমি নিয়ে স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রস্তাব উত্থাপন করে বৃটেন এবং তা পাশ হয়। পাশ হওয়ার পর দিনই ইসরাইল বৃটিশ সেনাদের সহযোগিতায় দশ লক্ষাধিক মুসলমানকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে প্রতিশ্রুত ভূমির চেয়ে বেশী অঞ্চল দখল করে নেয়। পরবর্তী আরব-ইসরাইল যুদ্ধগুলো কতিপয় আরব রাষ্ট্রের বিশ্বাস ঘাতকতায় এবং আমেরিকা-বৃটেনের নির্লজ্জ সহযোগিতায় যায়নবাদী চেতনার ধারক ও বাহক ইসরাইল নামক বিষ বৃক্ষটি ফুলে ফেপে ফিলিস্তিনের মানচিত্র গিলে ফেলে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ঔরসে জন্ম নেয়া অবৈধ দখলদার যায়নবাদী ইসরাইলের মূল লক্ষ্য হলিল্যান্ড- মিশরের নীল নদের তট থেকে ইরাকের ফোরাত। যায়নবাদী এ চেতনায় ক্রমবর্ধমান ভূমি কব্জা করার মিশন বাস্তবায়নে সচেষ্ট জারজ রাষ্ট্র ইসরাইল ।
যায়নবাদী চেতনায় তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বের অন্যসব মানুষকে নীচু জাতের বলে মনে করে। এ মনে করার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে- আল্লাহ তাআলা কবুল করেছিলেন ইব্রাহীম আ. এর দোয়া- যেন নবুয়তের অমীয় সুধায় সিক্ত হতে থাকে তার বংশধারা। তদীয় পুত্র ইসহাকের বংশেই পরবর্তী সকল নবী রাসূল আগমন করেছিলেন এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সা. এর আগমন হয়েছে তদীয় পুত্র ইসমাঈলের বংশেই। এ কথাই আল্লাহ বনী ইসরাঈল (ইসহাক পুত্র ইয়াকুব আ. এর বংশধর)-কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পবিত্র কুরআনে- আমি তোমাদেরকে সারা দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। বনি ইসরাঈল এমন এক গোষ্ঠী যাদের দাবী আল্লাহ মেনে নিয়ে আকাশ থেকে ভূনা মাংস খাবার হিসেবে নাযিল করেছিলেন। তারা অসংখ্য অগণিত আল্লাহর নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছিলেন, কিন্তু তাদের অবাধ্যতা, অহংকার, সীমালংঘনের ফলে, শত শত নবীকে হত্যার কারণে তারা আল্লাহর গজবে নিপতিত হয়ে যায় এবং কিয়ামত অবধি তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকবে।
ইহুদীরা নিজেদেরকে ইয়াকুব আ. এর পুত্র ইয়াহুযার বংশের এবং নবী মূসা আ. এর অনুসারী বলে দাবী করে থাকে। আজকের যুগেও তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করে। ইসরাইলী প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্য: গাজায় আমরা মানবপুশুদের সাথে যুদ্ধ করছি। ইহুদী পণ্ডিতের ভাষ্য: গাজার শিশুদের প্রতি রহম বা কৃপা করার কোন সুযোগ নেই কারণ ওরা বড় হয়ে আমাদেরকে হত্যা করবে এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো যায়নবাদী চেতনার বহি:প্রকাশ মাত্র। এই চেতনায় তারা ছলে বলে কৌশলে, অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে যায়নিষ্ট করে গড়ে তুলছে ভিন্ন ধর্মালম্বীদেরকেও। এ তালিকায় শুধু খ্রিস্টানরাই নয় মুসলমানের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে ইহুদীদের বেড়াজালে।
প্রাথমিক পর্যায়ে তারা বিশ্বব্যাপী রোটারী ও লায়নস ক্লাব নাম দিয়ে কাছে টানে এবং পরবর্তী ধাপে যায়নবাদীতার শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে ইহুদীদের প্রতি সহনশীল সহমর্মি বানিয়ে নেয়। বিশ্বের উঠতি নেতাদেরকে টার্গেট করে নিয়ে যায় তাদের আমেরিকান বারে এবং ক্ষমতার মসনদে বসানোর সকল আয়োজনের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে মনিটরিং ও সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। এভাবেই তারা গোটা বিশ্বের নেতাদেরকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায়।
গাযযা ও ইসরাইলের যুদ্ধের মধ্যে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেন সফর করেন তেলআবিব এবং নেতানিয়াহুকে আশ্বস্ত করেন এ বলে যে, তিনি খৃস্টান হলেও একজন পাক্কা যায়নিষ্ট। মিশরের সিসি আল ফাত্তাহ এবং আরব আমিরাত এর মুহাম্মদ বিন যায়েদ ইহুদীদের আমেরিকান বারের সদস্য ছিল। এদের কাজ কেবলী ইহুদী তোষণ।
ইন্দো-আমেরিকা-ইউরোপের ইহুদী তোষণের পেছনে শুধু ইসলাম বিদ্বেষ কাজ করছে এমনটি নয়, বরং ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা, ব্যবসায়িক পণ্য সরবরাহের রাস্তাকে নিরাপদ করা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বলয় তৈরী করে মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা।
এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইসরাইল রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা এদের জন্য খুবই জরুরী। ইসরাইলের হলিল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান তাদের উপর ফরয কর্তব্য, যাতে ইসরাইল ভূ-মধ্য সাগর-সুয়েজখাল-লোহিত সগর-ফোরাত হয়ে পারস্য উপসাগরের উপর কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে। এ ছাড়াও অযুত সম্ভাবনা রয়েছে ফোরাত নদীতে স্বর্ণের পাহাড় গজিয়ে ওঠার। এসব কারণেই রাশিয়া ও চীনও চায় মধ্যপ্রাচ্যের ঘুড়ির নাটাইটা তাদের হাতেই থাক। ইতোমধ্যেই তাদের যুদ্ধ জাহাজগুলো অবস্থান নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আশপাশে।
গাযযার হামাস, নারী, শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আর্তচিতকার মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের কাছে তাই মূল্যহীন। আরব রাষ্ট্রগুলোর দুর্বল শাসকদের কারণে ফিলিস্তিন বিশ্ব মানচিত্র থেকে বিলীন হওয়ার পথে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা. এর ভবিষ্যত বাণী- মালহামা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যাতে অংশগ্রহণকারীর ৯৯% মারা যাবে- আমরা কী সেই মালহামার চাক্ষুষ সাক্ষী হতে চলেছি? না কী রাসূল সা. এর আরেক ভবিষ্যতবাণীর বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি হামাস (হারাকাতুল মুকাওয়ামাতিল ইসলামিয়্যাহ-ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন) এর অসম যুদ্ধে?
রাসূল সা. বলেছিলেন: আমার উম্মতের একটি দল বিজয়ী হতে থাকবে যতক্ষণ না তাদের কাছে আল্লাহর হুকুম আসবে (কিয়ামত সংঘটিত হবে)এবং তারা বিজয়ী হবে। (বুখারী-৭৩১১, মুসিলম-১৫৬)। আমার উম্মতের একটি দল আল্লাহর নির্দেশে অবিরত থাকবে, যে কেউ তাদের ত্যাগ করবে বা তাদের বিরোধিতা করবে, সে তাদের ক্ষতি করবে যতক্ষণ না তাদের কাছে আল্লাহর হুকুম আসে এবং তারা মানুষের উপর বিজয়ী হবে। (মুসলিম-১০৩৭)। আমার উম্মতের একটি দল দ্বীনের প্রতি অবিচল থাকবে, তাদের শত্রুর উপর বিজয়ী হবে এবং যারা তাদের বিরোধিতা করবে তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, বরং তাদের উপর বিপদ-আপদ আপতিত হবে, যতক্ষণ না তাদের কাছে আল্লাহর হুকুম আসে এবং তারা এমনই হবে। তারা বললো: হে আল্লাহর রাসূল সা. তারা কোথায়? তিনি বললেন: বায়তুল মাকদিসে এবং বায়তুল মাকদিসের উপকণ্ঠে। (মুসনাদু
আহমদ-২১২৮৬)।
আশার আলো এটাই যে, ইসলামের স্বর্ণালী যুগের যুদ্ধগুলোও অসম ছিল। মুসলিম সেনাবাহিনী কাফির সেনাবাহিনীর তুলনায় সংখ্যায় ছিল নগন্য, কিন্তু তারপরও বিজয়মালা মুসলমানদের গলে শোভা পেয়েছিল আল্লাহর ইচ্ছায়। গাযযাহ মুক্ত করতে আজকে হামাসের প্রাণপণ লড়াই যেনো বদর যুদ্ধেরই প্রতিচ্ছবি।
ইয়ামানের হুতিরা ইরানের সহায়তায় বাবুল মান্দাব (মান্দাব প্রণালী) এর দখল নিয়েছে এবং আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের দোসরদের জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। আলজেরিয়া মরোক্কর উপর প্রেসার ক্রিয়েট করেছে জিব্রালটার প্রণালী (জাবালে ত্বরেক) বন্ধ করে দেয়ার জন্য এবং ইসরাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ আরব আমিরাত ও জর্ডানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রাষ্ট্রদূতদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে আলজেরিয়া। ইরানও জিব্রালটার প্রণালী (জাবালে ত্বরেক) বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করেছে। এটি সম্পন্ন হলে আমেরিকা-ইউরোপের বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধ্বস নামার আশংকা রয়েছে।
আমেরিকা-ইসরাইলের ইউরোপীয়ান মিত্ররা ইতোমধ্যেই কেটে পড়া শুরু করেছে। সৌদি আরব-মিশর যদি ইরানের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমেরিকা-ইউরোপকে ভাতে মারার পানিতে মারার ব্যবস্থা নিতে পারে তাহলে স্বাধীন ফিলিস্তিন বেশী দূরে নয়। খোদ পশ্চিম তীরে মাহমূদ আব্বাসের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা ফুসে উঠেছে। আল-কুদস ব্রিগেড, আল-আকসা ব্রিগেড এবং মুজাহেদীনে আকসা দখলদার ইসরাইলি সৈন্যদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে এবং বহু ইসরাইলি সেনাকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা ইনশা আল্লাহ স্বাধীন ফিলিস্তিনের পুনর্জন্ম দিবে সেই প্রতীক্ষায় রইলাম।
লেখক: প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক এবং প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), কুষ্টিয়া। রচনাকাল: ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রি.।