
|| প্রফেসর ড. মো: মযনুল হক, ইবি. কুষ্টিয়া ||
ইলমুন নুবুওয়াহ বলতে নবুওয়াতী জ্ঞান, ঐশী জ্ঞান বা ঐশী প্রত্যাদেশকে বুঝানো হয়। এ জ্ঞানের বিভাজন করা হয়ে থাকে দু’ভাবে
১. ওহী মাতলু -যা সালাতে পাঠ করা হয় ইবাদাত হিসেবে-আল-কুরআনুল কারীম
২. ওহী গায়রু মাতলু-যা পঠিত হয় না ইবাদাত হিসেবে-আল-হাদীস বা সুন্নাহ
উম্মাতে মুহাম্মদীর জন্য এতদুভয়কে আকড়ে ধরা ওয়াজিব।
রাসূল সা. বলেছেন: আমি দু’টো জিনিস তোমাদের নিকট রেখে গেলাম, যদি তোমরা এ দু’টোকে আকড়ে ধরো তাহলে পথ ভ্রষ্ট হবে না- ১. আল্লাহর কিতাব এবং ২. আমার সুন্নাহ (মুয়াত্বা ইমাম মালেক, ২/৮৯৯)।
রাসূল মুহাম্মদ সা. এর উপর ওহী বা ঐশী জ্ঞান -ইলমুন নুবুওয়াহ- এর সূত্রপাত হয়েছিল হেরা গুহায় আল্লাহর প্রত্যাদেশসহ জিবরাঈল আ. এর আগমণের মাধ্যমে। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস: জিবরাঈল আমীন এসে বললেন: পড়, রাসূল সা. বললেন আমি তো পাঠ করতে পারি না-আমি পাঠকারী নই। তিনি বললেন: জিবরাঈল আ. আমাকে বুকের সাথে স্বজোড়ে লেপ্টে ধরলেন যাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন: পড়, আমি বললাম:আমি পাঠকারী নই,….তিনি তৃতীয় বার বুকের সাথে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন: পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন চিবানো মাংস সদৃশ বস্তু থেকে। পড়, তোমার সম্মানিত প্রভুর নামে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি/সূরা আলাক ১-৩)।
রাসূল সা. এবার পাঠ করা শুরু করলেন: পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।…….
এ ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করছে যে, জিবরাঈল আ. রাসূল সা.কে বুকে চেপে ধরার পর রাসূল সা. পাঠ করতে সক্ষম হলেন-অর্থাৎ আল্লাহর প্রত্যাদেশ ওহীর জ্ঞান জিবরাঈলের বক্ষ থেকে রাসূল সা. এর বক্ষে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি পাঠ করা শুরু করেছেন। এই স্থানান্তরিত হওয়া প্রমাণ করছে যে, ইলম বা জ্ঞানের আধার ক্বালব, ব্রেইন নয়। বরং ব্রেইনকে পরিচালনা করছে এই ক্বালব, যা এক টুকরো মাংস ছাড়া কিছুই নয়। আর এই মাংস টুকরোর সুস্থ্যতার উপরই নির্ভর করছে গোটা দেহের সুস্থ্যতা। রাসূল সা. বলেছেন: নিশ্চয়ই মানব শরীরের মধ্যে এক টুকরো মাংস রয়েছে। আর এটা সুস্থ্য ও সঠিক থাকলে গোটা দেহ সুস্থ্য ও সঠিক থাকে। আর এটা নষ্ট হয়ে গেলে গোটা দেহ অসুস্থ্য ও বেঠিক হয়ে যায়। আর এটাকেই বলা হয় ক্বালব। (বুখারী, খণ্ড-১, পৃ. ২৯, হাদীস নং-৫২)
রাসূল সা. শরীরের সুস্থ্যতা ও অসুস্থ্যতাকে ক্বালবের অনুগামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর ব্রেইন শরীরেরই একটা অংশ এবং তার সুস্থ্যতা ও অসুস্থ্যতাও ক্বালবের অনুগামী। কাজেই জ্ঞানের আধার ব্রেইন নয় ক্বালব। আল্লাহ তা’আলা সূরা হাজ্জ এ বলেছেন: তারা কী পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি এবং তাদের ক্বালব ছিল যা দিয়ে তারা অনুধাবন করতে পারতো। (সূরা হাজ্জ-৪৬)। অপর একটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন: এর মধ্যে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তাদের জন্য যাদের ক্বালব রয়েছে। (সূরা ক্বাফ-৩৭)।
বহু শতাব্দী গবেষণার পর অধুনা বিজ্ঞান বলছে: মানবদেহ নিয়ন্ত্রণকারী ব্রেইন হলেও তাকে অন্য কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ ব্রেইন ক্বালব ছাড়া অচল। আল্লাহর নৈকট্য প্রত্যাশী বান্দাহরা এই ক্বালবের সুস্থ্যতার জন্যই সকাল সন্ধ্যা তাসবিহ তাহলীল পাঠ করে থাকেন।
ইলমুন নুবুওয়াহ এর এই ধারা যাতে অব্যাহত থাকে আল্লাহ তা’আলা তাবুক যুদ্ধের পর আয়াত নাযিল করলেন এবং নির্দেশ দিলেন যাতে রাসূল সা. কে ছেড়ে সবাই যুদ্ধে চলে না যায়। যুদ্ধের এ সময়কালে যাতে তারা রাসূল সা. এর পাশে থাকেন এবং এ সময়কালে অবতীর্ণ আয়াত ও রাসূল সা. মুখ নি:সৃত বাণী ও কার্যাবলী সংরক্ষণ করতে পারেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন: মু’মিনগণের উচিৎ হবে না যে তারা সবাই যুদ্ধে যাবে। বরং প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠী থেকে একটা ক্ষুদ্র অংশ বেরিয়ে পড়বে দ্বীন শেখার জন্য এবং ফিরে এসে তারা যাতে তাদের সম্প্রদায়কে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যাতে তারা সতর্ক হতে পারে। (সূরা-তাওবাহ-১২২)। এ আয়াত থেকে এটাও প্রমাণ হয় ইলম নিতে হবে সরাসরি উস্তাযের কাছ থেকে। এজন্যই হাদীস গ্রহণকারীর জন্য শর্তারোপ করা হয়েছে মুলাযামাতুশ শায়খ অর্থাৎ উস্তাযের সান্নিধ্য প্রমাণিত হতে হবে, না হলে তাঁর বর্ণিত হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
মানবমণ্ডলীর মধ্যে এরাই সেই সৌভাগ্যবান ক্ষুদ্র দল যারা আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক পছন্দিত ও নির্বাচিতগোষ্ঠী যাদেরকে আমরা ওলামা বলি। রাসূল সা. এই গোষ্ঠী সম্পর্কে বলেছেন: আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী। আর তাঁরা (নবীগণ) দিরহাম ও দিনারের উত্তরাধিকারীস্বত্ব রেখে যাননি, তাঁরা ইলমুন নুবুওয়াহর উত্তরাধিকারী স্বত্ব রেখে গেছেন। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করবে সে পূর্ণ মাত্রায় তা গ্রহণ করবে। ( আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, সহীহ ইবনু হিব্বান)।
ইলমুন নুবুওয়াহ উস্তাযের মুখ থেকে শুনে অর্জন করতে হবে তাহলেই জিবরাঈল আমীন যেভাবে এক বক্ষ থেকে আরেক বক্ষে স্থানান্তরিত করেছিলেন কুরআনের আয়াত সেভাবেই আজও স্থানান্তরিত হতে থাকবে ইলমুন নুবুওয়াহ তথা কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান। এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, তাহলে কী নিজে নিজে বই কিতাব পড়ে আলিম হতে পারবে না কেউ? পারবে, তবে রুহানিয়াত থেকে সে বঞ্চিত হবে এবং ইলমুন নুবুওয়াহর ধারাবাহিক সূত্র সনদ থেকেও সে বঞ্চিত হবে। এজন্যই আলিমগণ বলে থাকেন যার উস্তায বই/কিতাব হয়, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ভুলের মাত্রা বেশী পরিমাণে হয়ে থাকে। ইলমুন নুবুওয়াহ নিতে হবে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনতে হবে সরাসরি উস্তাযের মুখ থেকে যাতে তাঁর দ্বারা ভুলের মাত্রাটা কম হয়। এই ব্যবস্থাপনা আল্লাহ প্রদত্ত। রাসূল সা. বলেন: ইলমুন নুবুওয়াহ মানুষের বক্ষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে না বরং আলিমগণের মৃত্যুর মাধ্যমে আল্লাহ এ দুনিয়া থেকে ইলম তুলে নেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন: অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে যে ইলম দান করেছেন তা তোমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তুলে নেবেন না। বরং ইলম-ওয়ালা (বিজ্ঞ) উলামা তুলে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন। এমতাবস্থায় যখন কেবল জাহেলরা অবশিষ্ট থাকবে, তখন লোকেরা তাদেরকেই ফতোয়া জিজ্ঞাসা করবে। ফলে তারা নিজেদের রায় দ্বারা ফতোয়া দেবে, যাতে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে। (সহীহুল বুখারী ১০১, ৭৩০৭, সহীহু মুসলিম-৬৯৭১)। এ হাদীস থেকেও স্পষ্ট যে, ইলমুন নুবুওয়াহ বই পুস্তকে থাকলেও তা তুলে নেয়া হবে না, বরং পৃথিবীকে আলিম শুণ্য করে দেয়া হবে ফলে অজ্ঞরা ফতওয়া দেয়া শুরু করবে, নিজেরা পথ ভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথ ভ্রষ্ট করবে।
উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় বর্ণনাসূত্র বা সনদের গুরুত্ব অপরিসীম। চাই সেটা কুরআনূল কারীম হোক বা হাদীসে রাসূল সা. হোক।
সনদ (سند) শব্দটি একবচন, বহুবচনে আসানিদ (أسانيد)। এর আভিধানিক অর্থ-المعتمد বা বিশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা। সনদ (سند)কে এই জন্য المعتمد বলা হয়েছে যে, কুরআন তেলাওয়াতের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ও হাদীসের বিশুদ্ধতা একমাত্র সনদের উপর নির্ভরশীল।
আমরা জানি, কুরআন আল্লাহ তা’আলা লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত বোর্ডে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন সপ্ত আকাশের উপরে। সেখান থেকে বায়তুল ইজ্জাহ দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করেছেন এবং সেখান থেকে সম্মানিত ফেরেস্তা জিব্রাঈলের মারফত রাসূল মুহাম্মদ সা. এর নিকট পৌছিয়েছেন। এটি বর্ণনাসূত্রে মুতাওয়াতির, যা অবিকৃত অবস্থায় রাসূল সা.কে পৌছানো হয়েছে এবং তিনি তাঁর সাহাবার নিকট পৌছিয়েছেন।
কুরআনের ক্ষেত্রে সনদ বলতে বুঝায় হাফেযুল কুরআন এর সাথে রাসূল সা. এর সম্পর্কিত হওয়া। সনদ একটি অনুমোদিত জিনিস এবং এটি একটি সার্টিফিকেট যখন একজন ব্যক্তি পবিত্র কুরআন মুখস্থ করে এবং নিখুঁতভাবে পবিত্র কুরআন মুখস্ত করে। এই সার্টিফিকেটটি পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে হাফেযুল কুরআন এবং নবী মুহাম্মাদ সা.। এটি একটি মহা মূল্যবান যে একজন ব্যক্তি যখন রাসূলের সাথে সম্পর্কিত হন তখন তিনি গর্বিত হন, এটি একটি মহান সম্মান এবং গর্ব, কারণ ট্রান্সমিশনের চেইনটির একটি খুব বড় অর্থ রয়েছে, যা ওহী এবং মুবাল্লিগ এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এটি এক শায়খ থেকে অন্য শায়খের কাছে ট্রান্সমিশন হয়েছে এবং নবী মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত পৌঁছেছে। যেমন হাফসের বর্ণনাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপরিচিত পাঠ হিসাবে বিবেচনা করা হয় যা অনেক ব্যক্তি আয়ত্ত করেছেন। হাফস এটিকে তাঁর শায়খ আসিম বিন আবি আল-জানুদ থেকে গ্রহণ করেছিলেন, যার একটি ক্রমাগত ট্রান্সমিশন ছিল।
হাফসের বর্ণনার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল হাফসের এই পদ্ধতিতে চরম দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তিনি।
হাফসের বর্ণনার ধারাটি হাফস বিন সুলাইমান আল-কুফি আল-আসাদিকে বুঝায়, তিনি তাঁর উস্তায আসিম বিন আবি আল-নাজুদ থেকে, তিনি আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ বিন হাবিব আল-সুলামী আল-দারির, আবু মরিয়ম জির বিন হুবাইশ আল-আসাদী, এবং আবু আমর সাদ বিন ইয়াস আল-শায়বানী থেকে পাঠ করেছেন।
এই তিনজন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের কাছেও তেলাওয়াত করেছেন এবং আবু আবদুর রহমান আল-সুলামী এবং জির ইবনে হুবাইশও উসমান ইবনে আফফান এবং আলী ইবনে আবি তালিবে রা.এর কাছে তেলাওয়াত করেছেন, আল-সুলামীও উবাই ইবনে কা‘ব এবং যায়িদ ইবনু ছাবিত রা. এর কাছে তিলাওয়াত করেছেন। ইবনে মাসউদ, উসমান, আলী এবং উবাই ও যায়িদ ইবনু ছাবিত রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট তেলাওয়াত করেছেন।
কুরআনের এই সনদের ধারাবাহিক সূত্রই বাদশাহ ফাহাদ কমপ্লেক্স থেকে ছাপানো কুরআনুল কারীমে উল্লেখিত হয়েছে। হাফস আসিম থেকে, আসিম আব্দুর রহমান আল সুলামী থেকে, আব্দুর রহমান উসমান রা., আলী রা. এবং উবাই ইবনু কা’ব থেকে এবং তিনজনই রাসূল সা. এর নিকটে কুরআন তেলাওয়াত করেছেন। যদিও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের নিকট নাফের তেলাওয়াত পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য বেশী। নাফে’ সত্তর জন তাবেঈ এর নিকট তেলাওয়াত করেছেন তন্মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনু হুরমুজ আল আ’রাজ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস ও আবু হুরায়রা রা. নিকট তেলাওয়াত করেছেন। এতদুভয় সাহাবা রা. উবাই ইবনু কা’ব এবং যায়িদ ইবনু ছাবিত রা. এর নিকট তেলাওয়াত করেছেন। উবাই এবং যায়িদ রা. রাসূল সা. এর নিকট তেলাওয়াত করেছেন। আমাদের সময়কালের বিখ্যাত ক্বারী ছিলেন ক্বারী আব্দুল বাসিত আল-হাশেমী রহ. এর কুরআন তেলাওয়াতের সনদ রাসূল সা. পর্যন্ত পৌছেছে, যা আমার সংরক্ষণে আছে, লেখার ব্যাপ্তি বাড়াতে চাচ্ছি না বলেই উল্লেখ করছি না।
হাদীসের ক্ষেত্রে সনদ এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরো বেশী।
সহীহ হাদীসকে জাল হাদীস থেকে পৃথককরণের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমেই তারা হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই-বাছাই করেন এবং শরীআতকে মিথ্যা ও ভ্রান্তির সংমিশ্রণ থেকে রক্ষা করেন। কাজেই হাদীসের বিশুদ্ধতা সনদের উপরই নির্ভরশীল।(ইবনু হাযম, আল-ফিসাল ফীল মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ.২৪)
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল মুবারক বলেন: সনদ হলো দ্বীনের অংশ। যদি সনদ পদ্ধতি না থাকত তাহলে যে কেউ নিজ ইচ্ছামত বলতো।(খতীব আল বাগদাদী, আল কিফায়াহ ফী ইলমিদ দিরায়াহ, পৃ.৫৫৮)
সুফইয়ান ছওরী বলেন: সনদ হলো মুমিনের অস্ত্র স্বরূপ। যদি অস্ত্র তার কাছে না থাকে তাহলে সে কী দিয়ে যুদ্ধ করবে? ইমাম আওযাঈ বলেন: সনদ চলে যাওয়ার মাধ্যমে ইলমের অন্তর্ধান ঘটবে। মুহাম্মদ (সিরীন রহ.) বলেন: পূর্বের লোকেরা সনদ ও বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানতে চাইতো না। যখন ফিতনা শুরু হলো, তখন তারা বলতে লাগলো তোমরা আমাদেরকে বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অত:পর আহলুস সুন্নাহর নিকট থেকে হাদীস গ্রহণ করা হয় এবং আহলু বিদআতদের হাদীস পরিত্যাগ করা হয়। ইমাম আহম্মদ ইবনু হাম্বল (রহ.) বলেন: মুখতার সাকাফীর মাধ্যমে সহীহ হাদীসের মধ্যে বাতিল হাদীসের অনুপ্রবেশ ঘটলে সনদ প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন হয়।
হাদীসের সনদ বিষয়টি হাদীসের অংশ হিসেবে গণ্য হয়েছে হিজরী দ্বিতীয় শতকে। এর আগে সাহাবার যুগে এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি কারণ তারা কেউ মিথ্যাবাদী ছিলেন না। হাসান বসরী (রহ.-মৃত্যু-১১০হি:)কে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি হাদীস বর্ণনার সময় সনদ উল্লেখ করেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন: আল্লাহর শপথ! আমরা মিথ্যা বলি না এবং মিথ্যা আরোপিতও হই না।
আব্দুল্লাহ ইবনু আাব্বাস (রা.) যাকে চেনেন না তার বর্ণিত হাদীস শুনতেনও না, গ্রহণও করতেন না। এ থেকে সনদ যাচাই এর বিষয়টির সূত্রপাত সাহাবার যুগেই হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। হিজরী দ্বিতীয় শতকে এসে এটি ব্যাপকতা লাভ করে এবং এ সময়ে মুহাদ্দিসগণ সনদ ছাড়া হাদীস গ্রহণ করতেন না।
শিআ, খারেজী, রাফেযী ছাড়াও আরো অনেকে হাদীস জালকরণ ও মিথ্যা কিসসা কাহিনী তৈরী করেন, যা থেকে হাদীসের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণে সে সময়কার আলিমগণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন:
হাদীস জালকারীদেরকে মৃত্যূদন্ড প্রদানের ব্যবস্থা করা,
হাদীস বর্ণনায় সনদের উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা,
হাদীস বর্ণনাকারী থেকে শপথ নেয়া এবং
বর্ণনাকারীর পক্ষে সাক্ষ্য গ্রহণ করা ইত্যাদি।
প্রশ্ন- সিহাহ সিত্তার মতো গ্রন্থ সংকলিত হওয়ার পর সনদের গুরুত্ব কতটুকু? মুহাদ্দেসীনে কেরাম এটার গুরুত্ব কোন অংশে কমেছে, সেটা কখনই মনে করেননি এবং সে জন্যই হাদীস অধ্যায়নকারী ও বর্ণনাকারী প্রতিটি যুগেই হাদীস বর্ণনার সনদ উল্লেখ করেই হাদীস পাঠ শিখতেন এবং পাঠদান করতেন যার ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
আমি সরকারী মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার হাদীস বিভাগে যখন পড়ালেখা করি তখন শায়খুল হাদীস হিসেবে যাদেরকে পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম- মাওলানা ওবায়দুল হক জালালাবাদী, মাওলানা মাহবুবুল হক, মাওলানা ফখরুদ্দিন (চাটগামী), মাওলানা ওজিহ উদ্দিন চাঁদপুরী, মাওলানা আব্দুল লতিফ সিলেটীসহ আরো অনেক উস্তায। আমি কামিল হাদীসের ভাইবা বোর্ডে আমার সনদ উল্লেখ করে সহীহুল বুখারীর প্রথম হাদীস পাঠ করেছিলাম। (ভাইবা বোর্ডের এক্সপার্ট মেম্বার ছিলেন ছারছিনা দারুস সুন্নাহ কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা শরীফ মোহাম্মদ আব্দুল কাদির।)
আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আমাদের উস্তায আল্লামা ফখরুদ্দিন ও আল্লামা ওজিহ উদ্দিন তাঁদের উভয়ের উস্তায মুফতী আমীমুল ইহসান আল-মুজাদ্দেদী আল-বারাকাতী রহ. থেকে। তিনি তাঁর শায়খ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহসারামী রহ. থেকে। তিনি শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান থেকে। তিনি তাঁর শায়খ আহমদ আলী সাহরানপুরী থেকে। তিনি শাহ মুহাম্ম ইসহাক রহ. থেকে। তিনি তাঁর দাদা শাহ আব্দুল আযীয থেকে, তিনি তাঁর পিতা শাহ ওয়ালী উল্লাহ আহমদ ইবনু আব্দুর রহীম থেকে। তিনি তাঁর শায়খ আবূ তাহের মুহাম্মদ আব্দুস সামি’ থেকে তিনি তাঁর পিতা শায়খ বুরহানুদ্দিন ইব্রাহীম ইবনু হাসান আলকুরদী আল-মাদানী থেকে। তিনি তাঁর শায়খ সফি উদ্দিন আহমদ ইবনু মুহাম্মদ আল-কাশাশী থেকে তিনি শায়খ আহমদ ইবনু আলী আশ-শানাভী আল-মিসরী থেকে। তিনি শায়খ শামসুদ্দিন মুহাম্ম ইবনু আহমদ আর-রামলী আল-মিসরী থেকে, তিনি শায়খ আবূ ইয়াহইয়া যায়নুদ্দিন যাকারিয়া ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আহমদ আল-আনসারী থেকে, তিনি শায়খ আবুল ফদল শিহাবুদ্দিন আহমদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মদ আল-মা’রুফ বে-ইবনে হাজর আল-আসকালানী থেকে। তিনি শায়খ যায়নুদ্দিন ইব্রাহীম ইবনু আহমদ ইবনুল ওয়াহিদ আত-তানুখী থেকে, তিনি শায়খ আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দিন আহমদ ইবনু আবি ত্বলেব থেকে। তিনি শায়খ আবূ আব্দুল্লাহ সিরাজুদ্দিন হুসাইন ইবনুল মুবারক ইবনু মুহাম্মদ আয-যুবাইদী আল-হানাফী থেকে, তিনি আব্দুল আউয়াল ইবনু ঈসা ইবনু শুআইব ইবনু ইব্রাহীম আস-সাজাযী আল-হারাভী থেকে, তিনি শায়খ আবুল হাসান আব্দুর রহমান ইবনু মুহাম্মদ আল বুশুনজী থেকে, তিনি শায়খ আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনু আহমদ আস-সারাখসী থেকে, তিনি শায়খ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইউসুফ আল ফারবারী থেকে, তিনি শায়খ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল ইবনু ইব্রাহীম ইবনুল মুগীরাহ আল-জু’ফী আল-বুখারী থেকে। তিনি তাঁর উস্তায হুমায়দী আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর থেকে, তিনি সুফিয়ান থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-আনসারী থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনু ইব্রাহীম আত-তায়মী থেকে। তিনি আল-কামাহ ইবনু ওক্কাস আল-লাইসী থেকে শুনেছেন তিনি বলেছেন, আমি মেম্বারে দাঁড়ানো অবস্থায় ওমার রা.কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। পার্থিব উদ্দেশ্যে কেউ হিজরত করলে, অথবা কোন নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে কেউ হিজরত করলে তার হিজরত যে উদ্দেশে করেছে সেটার জন্যই গণ্য হবে। (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং-০১)।
এ হাদীসের সনদে রাসূল সা. পর্যন্ত পৌছাতে আমার এবং রাসূল সা. মাঝখানে উল্লেখ করেছি সাহাবী, তাবেঈসহ ২৯জন বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন যাদেরকে আমরা আকাবির বলে জানি। হাদীস বর্ণনার ধারবিাহিক সূত্র বা সনদই আমাদেরকে রাসূল সা. পর্যন্ত পৌছানোর একমাত্র মাধ্যম। আমাদের আত্মার প্রশান্তির জায়গা এটি।
আকাবিরদের সাথেই রয়েছে বরকত: ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন: বরকত রয়েছে তোমাদের আকাবিরদের সাথে। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৫৯)
আকাবিরদের থেকে ইলম্ নেওয়া কল্যাণকর: ইবনে মাসউদ রা. বলেন: মানুষ যতক্ষণ তাদের আকাবিরদের থেকে ইলম্ অর্জন করবে, ততক্ষণ তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে। (সিলসিলা ২/৩১০)
বাপ-দাদার ধর্ম, আকাবির পূজারী, পীর-মুরিদী কথাগুলো খুবই চটকদার কিন্তু ইসলামের মৌলিক উৎসসমূহ ধারাবাহিক বর্ণনা সূত্রে প্রথিত-এটাকে হেয় করা অর্থ ইলমুন নুবুওয়াতের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা। যদিও এ কথা সত্য যে, পীর-মুরিদীর নামে যা চলছে ডিজে গান, প্রকৃত আত্মিক সাধনায় জড়িতদেরকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। আকাবিরের সমজ বা বুঝ শক্তি অবশ্যই তাহকীক বা বিশ্লেষণের দাবী রাখে এবং সেই সাথে ফুকাহার মাসালেক মেনে চলা ইসলাম চর্চায় জীবনকে সহজবোধ্য করে তোলে। সেটাকে যদি কেউ বাপ-দাদার ধর্ম বলে গালি দেয় সেটাও এক ধরনের ঔদ্ধ্যত্যের শামিল। চার মাযহাবের ইমামগণ দলীল ভিত্তিক সমাধানের পথ খুজেছেন। এখন আপনার হাতে প্রচুর অনলাইন, অফলাইন তথ্য ভান্ডার মওজুদ আছে, কিন্তু সেগুলো থেকে মাসআলা ইস্তেমবাতের সক্ষমতা ক’জনের আছে সেটা বিবেচনার দাবী রাখে।
আমাদের ইউটিউবার কিছু শায়খের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এরা এর আহল বা যোগ্য নয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় রাসূল সা. এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারী স্বত্ব কুরআন ও হাদীসকে আকড়ে ধরে আকাবিরের তাকারীর ও তাওজীহাতকে বিশ্লেষণ করে আগামীর পথচলাকে সহজবোধ্য করে তোলার যথার্থ সক্ষমতা অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: অন্যতম জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ। রচনাকাল: ১১ জুলাই, ২০২৪ খ্রি.