
|| আব্দুর রহিম ||
শিক্ষার মূল ভিত গঠিত হয় শিশুদের প্রাক স্তরে। এই জন্যই উন্নত দেশগুলোতে কিন্টারগার্টেন বা নুরানি বা জান্নাতুল আত-ফালের গুরুত্ব অনেক। এখানেই শিশুকে আদব-কায়দা নীতি-নৈতিকতা শিখানো হয়।যার প্রভাব পরে পরবর্তী জীবনে।
সংযুক্ত ইবতেদায়ী মাদরাসায় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসায় নুরানি শাখা বা কিন্ডারগার্টেন শাখা চালু করা সময়ের দাবি। কারণ, একটা শিশুর হাতে খড়ি হয় প্রাক-ইবতেদায়ী স্তরে। সে সেখান থেকে শুদ্ধ উচ্চারণ, সুন্দর হাতের লেখা, বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আরবি, বিজ্ঞান এবং কম্পিউটারের মৌলিক অক্ষর-জ্ঞান শিখে।এর বাস্তব উদাহরণ হলো নুরানি কিন্ডারগার্টেন। সেখান থেকে যারা প্লে জামাত, নার্সারি ও কেজি জামায়াত শেষ করে আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। তাদের সাথে আর আলিয়ার নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সাথে তুলনা করলে বুঝা যায়, এই দুই ধারার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। কারণ এই স্তরে একজন শিশু একটা বর্ণের সঠিক লেখার পদ্ধতি ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখে। এখন সে যদি একবার ভুল শিখে, তাহলে তাকে সঠিকভাবে বর্ণ লেখা ও বর্ণ ও শব্দের বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখানো অনেক কষ্টকর। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে আর সঠিকভাবে লেখা শিখানো হয় না। কারণ নতুন ক্লাসে নতুন নতুন পড়া ও বিষয় চলে আসে। তখন হাতের লেখা ঠিক করানো ও বেইসিক শিখানোর সুযোগ হয় না।
কিন্তু আমাদের দেশের নুরানি কিন্ডারগার্টেন সেই কাজটি সফলতার সাথে করে যাচ্ছেন। তারা শিশুদেরকে অত্যন্ত যত্নের সাথে তা শিখিয়ে থাকেন। এইভাবে একজন শিক্ষার্থীকে শেখানো হলে সে আলিয়া মাদরাসা থেকে কলেজে আরবির ভয়ে চলে যাবে না এবং সে ভবিষ্যতে ভালো মানের আলেম হবেন।
আলিয়ার উপরের দিকের (দাখিল /আলিম /ফাযিল/ কামিল) স্তরগুলোতে ভালো মানের শিক্ষার্থী পেতে হলে এর গুরুত্ব অনেক। যা প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই বুঝেছেন।কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা বুঝতে পারলাম না (তবে কিছু কিছু মাদরাসা নিজ উদ্যোগে চালু করেছেন)।তারা এর গুরুত্ব বুঝে প্রাক-প্রাথমিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং দুইজন অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ করেছেন। তারা গবেষণা করে দেখেছেন যে, যারা বুয়েট, ডুয়েট, ঢাবি ও ঢামেকে চান্স পায় এবং বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বুদ্ধিজীবী এবং দার্শনিক হয়েছেন। তারা বেশিভাগাই কিন্ডারগার্টেনে ছোট বেলায় পড়াশোনা করেছেন।
এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধ এবং স্কুল ভীতি দূরীকরণের এর ভূমিকা ব্যাপক।
এবার আসি আমাদের মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রাথমিক শাখা নিয়ে কিছু কথা। জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় স্পষ্টভাবে প্রাক-প্রাথমিক মানে প্রাক-ইবতেদায়ী শাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর কী কী কাজ করেছেন, না চালু করেছেন প্রাক-ইবতেদায়ী শাখা এবং না করেছেন শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। মোট কথা, ইবতেদায়ী স্তর নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। অথচ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। রয়েছে হাজার হাজার দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদ্রাসা। এখন প্রশ্ন হলো এগুলোতে কারা পড়বে? আমার যদি কারখানাই না থাকে! ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলো হলো আলিয়া মাদরাসার কারখানা। আমাদের অভিভাবকদেরকে এই কথাটা বুঝাতে পারিনি!
২০০০ সালের শিক্ষা নীতিতে বিশেষ কিছু স্কুলে ১ বছর ব্যাপী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও এখন প্রায় সকল স্কুলে করা হচ্ছে। এর বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছিল যে ক্লাস ওয়ানের আগে ৬ মাস প্রিপেটরি শিক্ষা এবং ২০০৫ সাল নাগাদ এটিকে ১ বছর মেয়াদি করা হবে বলে সেই সময় বলা হয়েছিলো। এর পরে বলা হয়েছিলো যে এই প্রিপ্রাইমারিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এলাকার লোকেরাই এটির ব্যয়ভার বহন করবে।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩ এ বলা হয়েছে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি ৫ বছর বয়সী সকল শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাবেন। এই উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়টি করে নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি এবং বাড়তি ছয়জন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ এ ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ২ বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। যদিও সকল শিক্ষা কমিশন, নীতি এবং কমিটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটি পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বেসরকারিভাবে নার্সারি স্কুলগুলি এটি করছে যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। [কামরুন্নেসা বেগম এবং সারা সুলতানা]
প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভের পূর্বে ৬ বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা। ৩ থেকে ৫/৬ বছর বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের যত্ন, বেড়ে উঠা এবং শিশু অধিকার নিশ্চিত করা, খেলাধুলা, আনন্দ, অক্ষরজ্ঞান এবং গণনার হাতেখড়ির মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন এবং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সময় এটি।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে সাধারণত দুটি ধাপে বিভক্ত করা হয় ৩-৫ বছরের শিশুদের জন্য নার্সারি/প্লে গ্রুপ বা প্রাক-কিন্ডার গার্টেন এবং ৫-৬ বছরের শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক বা কিন্ডারগার্টেন। অবশ্য, কোন কোন স্কুলে ৩-৪ বছরের শিশুদের জন্য প্লে-গ্রুপ, ৪-৫ বছরের শিশুদের জন্য নার্সারি, ৫-৬ বছরের শিশুদের জন্য কেজি-১ এবং ৬-৭ বছরের শিশুদের জন্য কেজি-২ শ্রেণিতে শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
√ইবতেদায়ী স্তরে মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধিতে নিন্মলিখিত বিষয়গুলো চালু করা যেতে পারে:
★ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণ করা।
★ইবতেদায়ী স্তরে প্রাক-ইবতেদায়ী শাখা চালু করা।
★সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী স্তরে ফিডিং ও উপবৃত্তি প্রদান করা।
★ সংযুক্ত ইবতেদায়ী স্তর আলিয়া দাখিল, আলিম,ফাযিল ও কামিল থেকে পৃথক করা।
★প্রাথমিক অধিদপ্তরের মতো পৃথক ইবতেদায়ী অধিদপ্তর চালু করা।
★সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা (ফাযিল/ অনার্স) ও বেতন বৃদ্ধি করা।
★শিক্ষার্থীদের প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা।
★ ইবতেদায়ী স্তরে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শ্রেণি কক্ষে পেইন্টিং করা।
★ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য পিটিআই এর মতো ইটিআই চালু করা।
★ শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করা।
★ কম্পিউটার ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া।
★আরবি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে ল্যাংগুয়েজ ক্লাব চালু করা।
আমরা যদি নুরানি কিন্ডারগার্টেনের মর্ম উপলব্ধি করি ও গুরুত্ব বুঝি, তাহলে অচিরেই এই শাখা চালু করা দরকার। দীর্ঘদিনের গবেষণা এটাই প্রমাণ করে। আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী কম ও ঝড়ে পড়া মানসম্মত আলেম তৈরি না হওয়ার পিছনে এইগুলোই মূল কারণ।আমাদের কারখানায় ভালো কাচামাল দিতে পারলে পোডাক্ট ইনশাআল্লাহ ভালো হবে।
লেখক: শিক্ষক, সৈয়দ আব্দুল মান্নান ডি. ড. এফ. আলিম মাদরাসা, বরিশাল।
মাশাআল্লাহ। সুন্দর এবং বাস্তবিক আলোচনা। দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।