বুধবার, জুন ১৮

আমি এক দুধের শিশু, আমার কি দোষ ছিলো?_কবিতা

পৃথিবীতে আমার আগমনের পথ প্রশ্নসিদ্ধ বলে
মোর মনোআঙিনায় দাবানলের থাবায় তপ্ত হৃদয়
আমাকে ঘুমাতে দেয় না।

হাটে, মাঠে, ঘাটে আর লোকালয় জনপদে
আমার বিশেষায়িত নাম জারজ শব্দটি আমাকে
তটস্থ রাখে সব সময় ।
অথচ আমার কি দোষ ছিলো?

সুবিশাল পৃথিবীর সীমাহীন আকাশের নীচে,
সবুজ জমিনে আর দশটা শিশুর মতোই
মায়ের উদরে জন্মেছিলাম।
হয়তো নির্ধারিত সময় বা অপরিপক্ক সময়ে
কোন মায়ের পেট চিড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো আমার।

হাত পা ছুড়ে পৃথিবীর প্রথম ভাষা কান্নায়
ঠোঁট মুখ নেড়ে জমিনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম।
কোন নারী আমার মা? কোন পুরুষ আমার বাবা?
তা আমার অভিধানে তখন অজানা ছিলো।

আমি এসেছি এ ধরায় এটাই নির্মম সত্য।
আমি এক অবোধ শিশু, আমাকে পৃথিবীতে আনার
প্রক্রিয়া বৈধ না অবৈধ ছিলো তা আমি জানি না।
অথচ আমার কি দোষ ছিলো?

হৃদয়হীনা শব্দ দিয়ে মায়ের ভালোবাসাকে নিম্নগামী
করতে চাই না আমি।
গর্ভধারিণী মাকে কালো, ফর্সা, লম্বা, বেটে পাপিষ্ঠা
আর শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মাপকাঠিতে
ওজন করতে চাই না আমি।
কিন্তু আমার কি দোষ ছিলো?

বনজঙ্গলে আমাকে রেখে লাপাত্তা হলে কেন মা?
তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণায় তোমার প্রস্থানের পথে পলক
রেখে বলেছিলাম মা আমাকে নিয়ে যাও।
ভ্রুপেক্ষ করোনি আমার আকুতিকে ——–।

সমাজ সভ্যতা আর বিধি বিধানের ভয়ে তড়িঘড়ি
তোমার প্রস্থান যে কতোটা বেদনাদায়ক, তা ভাষাহীন
মনে তা প্রকাশের সাধ্য ছিলো না আমার।
কিন্তু আমার কি দোষ ছিলো?

কোন এক ক্ষুর্ধাত শৃগাল আহারের বস্তু ভেবে
মুখে করে নর্দমায় রেখে শিকারীর খোঁজে
গিয়েছিলো অন্যত্র।
শীতের কুয়াশা কেটে সুপ্রভাতের আলোর ফুয়ারায়
কোন এক পাতাকুড়ানির নজরে পড়েছিলাম আমি।

মায়াবিনী বৃদ্ধা ছকিনার ঘরে পলে পলে বেড়িছিলো
আমার হৃদপিণ্ডের শাখা প্রশাখা।
বন্ধ্যা বিধবা ছকিনার আঙ্গুলের প্রলেপে কপালে
কালো টিপে বেড়েছিলাম এক অচিনপুর গায়ে।
কিন্তু কে আমি?
আমার কি দোষ ছিলো?

দোলনায় ধাক্কা খেতে খেতে বৃদ্ধা ছকিনার দেওয়া
দুধের বোতলে ঠোঁট নেড়ে দুগ্ধপানে
ঘুমিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু কি মোর পরিচয়?
নিবন্ধনকৃত মা বাবার নামই বা কি?
কে জন্ম দিয়েছে মোরে? উপাধি আমার জারজ পুত্র।
অথচ আমার কি দোষ ছিলো?

ষোলোআনা দোষই ছিলো তোমাদের।
আজ সভ্যতার সাইনবোর্ডে আমি বড্ড বেমানান,
জারজ সন্তানের কালিমা আমার শরীর ও ললাটে।
আমার আশ্রিতা বিধবা ছকিনার প্রতিবেশি
ফুলমতি তো বলেই ফেলল আহা কি সুন্দর
হয়েছে৷ গো—–।
কিন্তু এটা কার যে পাপের ফসল?
নবজাতককে কেউ কি ডাষ্টবিনে ছুড়ে মারে?
আমার শিশু হৃদয়ে কথাগুলো সূঁচ ফোটানোর মতোই
লেগেছিলো। কিন্তু আমার কি দোষ ছিলো?

আমি তো অট্টালিকার বাসিন্দা হতে চাইনি,
হতে চাইনি সোনার চামচে জন্ম নেওয়া কোন শিশু।
আমার চাওয়াটা ছিলো স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক,
মায়ের কোলে মাথা হেলিয়ে ঘুমাতে চেয়েছিলাম।
হাত পা নেড়ে তোমার বুকের শালদুধ পান করা
আমার কিসমতে নাই বা হলো,
চেয়েছিলাম তোমার একটু সোহাগ ———।

জন্মের পরেই কেন ছুড়ে দিলে বনবাদড়ে
বেওয়ারিশের টোকন গলায় দিলে পড়িয়ে।
আমি মরেনি মা, মরলে বেওয়ারিশ লাশ,
বাঁচলে সভ্যতার চোখে পিতৃহীন পরিচয়ে যদু আর মধু।
কি এক অদ্ভুত পৃথিবী,
কিন্তু আমার কি দোষ ছিলো?

আমি স্বইচ্ছায় পৃথিবীর আলো দেখতে চাইনি?
কেন আনলে মোরে? কেনই বা অনাদর আর
আমাকে নিয়ে লোকচক্ষুর ভয়?
আমার গর্ভধারিণী কে? কে আমার জন্মদাতা পিতা?
দুঃখ শুধু আমার আপাদমস্তকে।
আমার কি দোষ ছিলো?

হয়তো পুর্ণাঙ্গ জীবনে, সময়ের সন্ধিক্ষণে,
মা বাবার নাম জানতে চাইলে
কি বলবো হে গর্ভধারিণী?
তুমি তো উগলে দিয়েই খালাস,
কিন্তু একটি বিশেষণে আমি জর্জরিত–” জারজ”
তাই আমার কি দোষ ছিলো?

জন্মের পরেই আমার নিঃশ্বাসটা আটকে
গেলেই ভালো হতো। অথবা আমার গলা চিপে ধরলেই
ল্যাটা চুকে যেত, কিন্তু ছুড়ে মারলে কেন?
আমার কি দোষ ছিলো?

পিতৃহীন পরিচয়ে আমি নামের শিশুটির
আকুতি শোনো হে বিচিত্র পৃথিবীর মানুষেরা,
বক্তে মোর হাজারো জিজ্ঞাসা —–।
তাই কেউ কি একটু আদর দিবে?
আমারো তো প্রীতি প্রণয়ের স্বপ্নসুর আছে,
স্নেহ ভালোবাসা পাওয়ার এক মুঠো অধিকার আছে,
দূরে ঠেলে দিবে জারজ সন্তানের ধোঁয়া তুলে?
কিন্তু না, আকুতি জানাই সবার তরে
আমার কি দোষ ছিলো???

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *