|| মো. ওমর ফারুক ||
মহান স্রষ্টার বিশ্বলোক সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানুষকে ঘিরে। মানুষের প্রয়োজনার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে ভুবনের সমস্ত কিছু। সর্বোত্তম সৃষ্টি হিসেবে মানুষকে জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন করে তৈরি করা হয়েছে। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বলোকের অন্যান্য সৃষ্টির সাথে পরিচিত হয়, গড়ে তোলে নিবীড় সম্পর্ক, পরিচালিত করে নিজেকে, দেশ, সমাজ ও জাতিকে। সৃষ্টিকুলের সাথে নিবীড় সম্পর্কে জড়িয়ে অনেকে তার স্রষ্টাকেই ভুলে যায়। ভুলে যায় তার অস্তিত্বের কথা, গোড়ার কথা। হারিয়ে ফেলে খোদার দেয়া সরল-সঠিক পথ। দুনিয়ার মোহে পাপ-পঙ্কিলতার সাগরে হাবুডুবু খায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে নবী-রাসুল, ওলি-আওলিয়া ও সুফি-দরবেশ পাঠিয়েছেন এ সকল পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য, পাপ-পঙ্কিলতা বিদূরিত করতঃ অন্তঃকরন পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করা জন্য। মহান রবের এ সকল পূণ্যবান বান্দা দিশেহারা জাতির মাঝে খোদায়ী দ্যুতি ছড়িয়ে তাদের মহাসত্যের পথে পরিচালিত করেছেন। প্রচার করেছেন ঐশী বাণি, তুলে ধরেছেন সৃষ্টির রহস্য, সেতুবন্ধন করেছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে।
এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আগমন ঘটেছিল বাংলার রুমি শাহসুফি সৈয়দ আহমদুল হক (রহ.)-এর। তিনি ১৯১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পদুয়া ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার ৯৩ বছর বয়সে ইহজগত ত্যাগ করে খোদার সান্নিধ্য লাভে পরলোকগমণ করেন। মানবমুক্তির ফেরিওয়ালা বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবস সোমবারের সাথে বাংলার রুমির জন্ম ও ওফাত দিবসের মিল হওয়ায় এটি অনেক বরকতের ও অত্যন্ত গৌরবের।
সমকালীন যুগশ্রেষ্ঠ ওলি, ধর্মীয় দীক্ষাগুরু, জ্ঞানতাপস, শাহসুফি হযরত মৌলানা সৈয়দ সিরাজুল হক (রহ.) প্রকাশ সিরাজ বাবা (১৮৮৯-১৯৫২ খ্রি.)-এর ঘরে ও বিশিষ্ট ওলি বংশে জন্মগ্রহণ করলেও বাংলার রুমি আধ্যাত্মিক চেতনা ধারণ করে জেনারেল শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। জেনারেল শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ইসলামিক আধ্যাত্মিক দীক্ষাসহ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে জ্ঞানার্জন করেন। শিক্ষকতাসহ সাব-রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে ডাইরেক্টর পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের তাঁর রয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। জনাব সৈয়দ আহমদুল হক তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতিটি দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। বাংলার রুমি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, হৃদয়ের বিশালতা, উদারপ্রবণ সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, আধ্যাত্মিক সাধনা, নেতৃত্বের গুণাবলি ও অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁকে করেছে অনন্য। তিনি চাকুরীর পাশাপাশি জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করেছেন অবলীলায়। অধ্যাত্মবাদ গবেষণা, চর্চা ও প্রচারণায় তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম সাধুপুরুষ। তাঁর গবেষণা ও রচনাগুলো যেমনি ভাষাশৈলী, তেমনি হৃদয়গ্রাহী। তাঁর লিখনীর পরতে পরতে রয়েছে ঐশী প্রেমের এক দারুন পরশ।
তিনি তাঁর মসির মাধ্যমে যেভাবে অর্থনৈতিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন, আবার সেভাবে তাঁর ক্ষুরধার লিখনী ও বক্তৃতামালা দিয়ে মানবমুক্তির পয়গাম তুলে ধরেছেন। যাতে মানবকুল তাদের অন্তঃকরন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে ঐশী প্রেমে বিগলিত হয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভে ধাবমান হতে পারে। বাংলার রুমির সুফিতাত্ত্বিক সাধনা গবেষণা ও প্রচারণা শুধু দেশের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্তি ঘটিয়েছেন ব্যাপক। তিনি পারস্যের বিখ্যাত সুফি কবি, দার্শনিক ও প্রেমবাদের প্রবক্তা মৌলানা জালালুদ্দিন রুমিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁর আধ্যাত্মিক রচনাগুলো বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। অধ্যাত্মবাদ গবেষণা, চর্চা ও সর্বজনীন প্রেমের বাণি প্রচারে প্রতিষ্ঠা করেছেন আল্লামা রুমি সোসাইটি। বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণ করে প্রেমবাদ প্রচারে অংশগ্রহণ করেছেন নানাবিধ সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে। বাংলার রুমি মানবতা, মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণের জন্য তরী ভাসিয়েছেন আধ্যাত্মিক প্রেম দরিয়ায়। তিনি সর্বজনীন প্রেমতরীর কাণ্ডারী হয়ে বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাঁর উদারতা, মহানুভবতা, পরোপকার ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। এ কারণেই তাঁর স্নেহধন্য হয়েছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। নামাজের সময়ে জেলের ঘরের পরিষ্কার কাপড় নিয়ে নামাজের মুসল্লা বানিয়ে তিনি নামাজ আদায় করেছেন নির্দিধায়। ইহজগতের বাংলার রুমির চেয়ে আলমে মালাকুতে পাড়ি জমানো বাংলার রুমির শক্তিই প্রবল। কেননা, তাঁর ক্ষুরধার লিখনীগুলো জীবন্ত। সেগুলো অধ্যয়ন করে দিশেহারা মানুষগুলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভে ধন্য হয়ে স্রষ্টার সাথে নিবীড় সম্পর্ক গড়ার দিশা খুঁজে পাচ্ছে। তাঁর বড় সাহেবজাদা শাহসুফি সৈয়দ মাহমুদল হক যৌগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আল্লামা রুমি সোসাইটি বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে বাংলার রুমির রচনাবলী সমগ্র দেশ-সহ বহির্বিশ্বে প্রচার করে চলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-ইস্টার্ণ হিল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার রুমি ও তাঁর রচনাবলীর উপর এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে। দেশের শিক্ষার সকল স্তরে বাংলার রুমির রচনাগুলো পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভূক্ত করতঃ চর্চার দাবি রাখে।
লেখক: এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।