|| খাজা ওসমান ফারুকী (খাজা’জী) ||
সুফি মেডিটেশন বা ধ্যান হলো এক সুন্দর, শান্ত-শীতল চর্চা যা আধ্যাত্মিক বোধের স্তরকে শানিত করে, সচেতনায় বেহেস্তীয় উপস্থিতিকে ডেকে আনে এবং আত্মাকে প্রশান্ত করে তোলে। এই ধ্যানের কাজটি করতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ, শ্রদ্ধাপূর্ণ ও এক প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় যা আমাদের জীবনের কষ্টময়-উত্তেজনাকর সময়ের জন্য একমাত্র প্রয়োজন। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ মানুষের চিত্তকে প্রশান্ত করে’ (সূরা রাদ: ২৮)।
আমরা আজকাল যে কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীতে বাস করি, সেখানে মানসিক শান্তি পাওয়া দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। এই বিশৃঙ্খলাময় আধুনিক জীবনে মানুষ দ্রুত শান্তি খুঁজে পাওয়ার পথ খুঁজছে। সম্ভবত এই কঠিন অর্জনটির জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধ্যান অনুশীলন। মননশীলতা ও আত্ম-প্রতিফলনের গভীরে প্রবেশ করার জন্য ধ্যান এমন একটি প্রাচীন কৌশল, যার কোনো সীমানা নেই। ইসলামে ধ্যান তথা ‘মেডিটেশন’কে গভীর স্তরে আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়। এটি ব্যক্তিকে আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করতে, তাঁর নিদর্শন খুঁজতে এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক গভীর করতে সাহায্য করে।
সুফি মেডিটেশন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দেয় এবং আমাদের অবচেতন মন, চিরন্তন এই আধ্যাত্মিক জগতের দরজা দিয়ে তাতে প্রবেশ করে। সুফি মেডিটেশন মানে নিজেকে টুকরো টুকরো করে জানার সাধনা। দেহ মনে জমে থাকা বহু বছরের বিকার, যাতনা ও ব্যাধি থেকে মুক্তির সহজ উপায়। বাস্তব জীবনের উন্নতি, আধ্যাত্মিকতা, স্বাস্থ্য বা ফিটনেস যাই হোক না কেন, আপনার আকাঙ্খা অর্জনে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য সুফি মেডিটেশন সহায়ক।
পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরে সমস্ত সৃষ্টির উপর চিন্তা করা ইবাদাত হিসেবে গণ্য এবং গভীর চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সময়, স্থান ও সীমাকে ছাড়িয়ে সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার উৎসাহ কুরআনে বারবার তাগাদা হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে: ‘বলো, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াও। দেখ, আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন। একইভাবে আল্লাহ পুনরায় সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সূরা আনকাবুত : ২০)
কুরআন বিশ্বাসীদেরকে বর্তমানকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নিয়তি ও বিলুপ্তি নিয়ে ভাবতে বলেছেন : ‘ওরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? ওরা কি দেখেনি ওদের পূর্বসূরিদের পরিণতি কী হয়েছিল? শক্তিতে ওরা ছিল এদের চেয়েও প্রবল…’ (সূরা রুম: ৯)
কুরআন বিশ্বাসীদের গভীর চিন্তা করার সাথে সাথে পরের পৃথিবীর জন্য ধ্যান করতে আহ্বান করছেন: ‘…এভাবেই তাঁর বিধানসমূহ সুস্পষ্ট বলে দেন, যাতে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় স্থানের জন্যই গভীরভাবে চিন্তা করতে পার…’ (সূরা বাকারা: ২১৯-২২০)।
এর কারণ, কিছু চিন্তা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ, যা আসলে মহাবিশ্বের অপূর্ণ প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলে এবং তা মানবীয় বাস্তবতার অস্তিত্বের আলোকে কিছুটা বিকৃত চিন্তার রূপ প্রদান করে মাত্র। তাই, বিশ্বাসীদেরকে শুরু থেকে শেষবিচারের দিন পর্যন্ত সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার কথা বলা হয়েছে। গভীর চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা সম্পর্কে কুরআন স্রষ্টার প্রাকৃতিক সৃষ্টির উপর ধ্যান করার আহ্বান করেছেন; যেখানে মানুষের ভূমিকার বাইরে স্বর্গ, পাহাড়-পর্বত এবং সমুদ্রও বাদ যায়নি।
কুরআন অবশ্য বিশ্বাসীদের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন- মানুষের প্রাপ্য নিয়ামতরাজির উপর, যার মধ্যে আছে ওই সকল অর্জন, যা দ্বারা মানবতার সেবা করা হয়। আল্লাহ কুরআনের মধ্যে বলেছেন, তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং যা কিছু মানুষ মন ও হাত দিয়ে তৈরি করে তাও: ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে ও তোমরা যা তৈরি করো তাও।’ (সাফফাত: ৯৬)। সুতরাং বলা যায়, আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের যে দুর্গতি, এর কারণ হলো তারা স্রষ্টার নিয়মকানুন পৃথিবীর ক্ষেত্রে মানে না।
জগতের বিমূর্ত অর্থ আধ্যাত্মিকতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি। ব্যক্তির আধ্যাত্মিকতার বিকাশ টাকাপয়সা অর্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লোকেরা প্রায়শই বিশ্বাস করে যে, বিনোদন, সম্পদ ও সম্পত্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষণস্থায়ী সুখ তাদের উদ্বেগ থেকে বাঁচাতে পারে। আপনি যখন এই পৃথিবীর সমস্ত বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করবেন, তখন আপনি ক্ষতির মধ্যে পড়বেন। আপনার মন অনিবার্যভাবে আপনাকে এই বোঝার দিকে নিয়ে যাবে যে, পার্থিব জীবনের সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।
কারণ, এই পৃথিবীতে আপনার সমস্ত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার শেষ আছে। আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে, অথবা আপনি আপনার লক্ষ্যগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এই দুই প্রান্ত থেকে মুক্তির পথ নেই আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া। এই পৃথিবীর সাময়িক প্রকৃতি অনিবার্যভাবে একজন ব্যক্তিকে অস্তিত্বের সংকটের দিকে নিয়ে যায়। এর বিপরীতে আধ্যাত্মিকতাই আমাদের জীবন ও জীবনকে বেঁচে থাকার যোগ্য করে তুলতে পারে।
এক পাগলাটে ধরনের ব্যস্ততায় আসক্ত মানুষ, শুধু ‘পাশ্চাত্যের’ মানুষেরা যে এই অভিশাপের শিকার তা নয়, বরং এর সাথে সবাই যারা এই পাশ্চাত্য সমাজের বর্ধনশীল বস্তুবাদ দ্বারা প্রভাবিত, পৃথিবীর সকল মানুষই এর করাল থাবায় নিষ্পেষিত। মানুষের মানসিক চাপ এবং মানসিক অসুস্থতার ফলে তার সাথে সমান্তরালে বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বেগ, হতাশা, অত্যধিক বাধ্যতামূলক ব্যধি (OCD) ও আত্মহত্যা। ইউভাল নোয়াহ হারারি তার বই ‘হোমো ডিউস’-এ বলেছেন, আধুনিক মানুষ যুদ্ধে বা দ্বন্দ্বে মারা যাওয়ার চেয়ে আত্মহত্যায় মরতে বেশি পছন্দ করেন। যা বলে দেয়, আমরা একটা মহাসংকটে আছি। চরম উদ্বেগ, অশান্তি, অসুখ এবং যে হতাশা দেখা দিচ্ছে তার উৎপত্তির কারণ ভারসাম্যহীন, আধ্যাত্মিক সংযোগবিহীন পাশ্চাত্যের জীবন যাপনের দায়; যা এখন সারা পৃথিবীব্যাপী চলমান। এই প্রাথমিক, মানবিক আত্মার উচ্চসম্ভবনা অর্জন করা আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞানের উচ্চদৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। সেই অগ্রগামী আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞানের আলোকে, ধ্যানের চর্চা নিঃসন্দেহে সমাজের ব্যক্তিকে একটা ভালো মানুষে রূপান্তরিত করতে পারবে।
বিগত কয়েক শতাব্দীতে প্রচুর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও মনে হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বিষন্নতার হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যমতে, এই সময়ের জনসংখ্যার মধ্যে অ্যান্টিডিপ্রেশেন্টের ব্যবহার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তরুণদের (১৪-২৪ বছর বয়সী) আত্মহত্যার হার তিনগুণ বেড়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মধ্যবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আশ্চর্যজনকভাবে আত্মহত্যার হার দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় ধনী দেশগুলোতে অনেক বেশি। ১৩২টি দেশের প্রায় ১৪০,০০০ জন মানুষের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদিও ধনী অঞ্চলে উল্লিখিত সুখের হার বেশি ছিল, তবে দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় ওদের জীবনের অর্থ কম ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, আত্মহত্যার একটি মূল কারণ হতে পারে জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
আধুনিক জীবন দিনকে দিন জটিল হয়ে উঠছে। প্রতিটা দিন কাটছে মানসিক চাপ, বিক্ষিপ্ততা ও অতিরিক্ত তথ্য মাথায় জমা করে। আমাদের ইন্দ্রীয়গুলো ক্রমান্বয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে। আমাদের এই ক্রমাগত যুদ্ধ মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। আমাদের ইবাদাত-বন্দেগীর গুণমান কমিয়ে দেয়। আমরা সকলেই জানি, ইবাদাতে আমাদের আরো বেশি মানসিক উপস্থিতি প্রয়োজন। আমাদের এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো মনকে আরেকটু নিয়ন্ত্রন করা দরকার। আমাদের আকাঙ্খার উপরেও নিয়ন্ত্রণ দরকার। কিন্তু ঠিক কি উপায়ে আমরা এটা অর্জন করতে পারি? এখানেই সুফি মেডিটেশন বা মুরাকাবার প্রয়োজনীয়তা।
আপনি যেই হোন না কেন, ধ্যান সবার জন্যই উপকারী। কারণ বয়স, পেশা বা আকাঙ্ক্ষা, ধ্যান নির্বিশেষে প্রত্যেককেই স্বাগত জানায়। যে কেউ ধ্যান অনুশীলন থেকে উপকৃত হতে পারে। এটি স্ট্রেস কমাতে, ফোকাস বাড়াতে, মানসিক সুস্থতা উন্নত করতে, ঘুমের রুটিন ঠিক করতে এবং জীবনে আরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি এক উজ্জ্বল, উষ্ণ, প্রশান্তিময় ও কর্মমুখর জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। অর্জন করবেন মানসিক প্রশান্তি, আধ্যাত্মিকতা ও সর্বাঙ্গীণ সুস্থতা।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, সুফি সেন্টার, চট্টগ্রাম।