বুধবার, ডিসেম্বর ৩

রাজনীতি ও কূটনীতি

২০২৫ সাল অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছে বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা আলোচিত হয়েছেন নিজের বক্তব্য ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন অনেক, যার ফলে বিশ্বের সাথে সম্পর্ক কিছুটা না—অনেকটাই খারাপ হয়েছে। নিজ রাষ্ট্রে নিজে অনেকটা নিন্দিত হয়েছেন সিদ্ধান্তের জটিলতায়। আফগানিস্তানে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে। ইরানের সাথে যে বৈরিতা সৃষ্টি করেছেন তার খেসারত দিতে হয়েছে নানা ভাবে। উপমহাদেশের কূটনীতিতে বিভেদ টানার চেষ্টা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মার্কিন শুল্কনীতির ফলশ্রুতিতে অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক এতটা খারাপ হয়েছে যে এখন মার্কিন অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটি নিয়ে বেশ চিন্তিত—এটি মার্কিন অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা লক্ষ্য করলেই টের পাওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক অনেকটা তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও ভারত কোনো আপস করতে চায়নি। আফগানিস্তানের সাথেও বৈরিতায় লিপ্ত হতে হয়েছে। কূটনীতিতে ‘শেষ’ বা ‘সমাপ্ত’ বলে কোনো শব্দ নেই। সব কথার একটিই কথা—চলমান থাকবে। দৃশ্যত আমরা দেখতে পেয়েছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা চাপ প্রয়োগ করে শুল্ক আলোচনার শেষে শর্তসাপেক্ষে শুল্ক হ্রাস করতে রাজি হয়েছে, যেটি অন্য দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। চীন শতভাগ শুল্ক আরোপের খড়গ মাথায় নিয়ে কোনোভাবে মাথা নত করতে রাজি হয়নি। যতই সমস্যার মধ্যে থাকুক না কেন, চীন তার অর্থনীতিকে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে ভারত এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে। চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য সাংহাই সম্মেলনে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক দৃঢ়করণে। রাশিয়া, চীন এবং ভারত একসূত্রে নিজেদের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে আফগানিস্তানকে সাথে নিয়ে। পাকিস্তানের সাথে বৈরী সম্পর্ককে সামাল দেওয়ার জন্য আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সাথে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছে, যা ভারতের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনতে চলেছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পরপর দুজন মন্ত্রীর ভারত সফর অনেক গুরুত্ব বহন করে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ২০২৫ সালে কঠিন ভূমিকা নিতে হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরী সম্পর্ককে অনেকটা কাজে লাগাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া খুব সহজেই এশিয়াতে তার প্রভাব বিস্তারের পথে নেমেছে। চীন, রাশিয়া, ইরানকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের অবস্থান মুসলিম বিশ্বের কাছে অনেকটা গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে ইরানের পাশে থেকে বন্ধুত্বের যে পরিচয় দিয়েছে তার দুঃসময়ে, সেটি কিন্তু কম নয়। দিল্লিতে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের সময়ে ইরানের যে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে সেটি ভারতের মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সহযোগিতা করেছে। ভারত এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্ক উদ্ধারেও তৎপর, ঠিক তেমনিভাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। কাতার মধ্যস্থতা করলেও ফলপ্রসূ হয়নি আফগান তালেবান ও পাকিস্তানের শান্তি আলোচনা। সৌদি আরবের সাথে সহযোগিতার যে চুক্তি, সেটিও কিন্তু অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে।

বছরের শেষে বড়দিনের উপহার হিসেবে ভারত পেতে যাচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে। রাশিয়ার তেলের অন্যতম গ্রাহক ভারত। দিল্লি রাশিয়ার কাছ থেকে বেশ কয়েকদিন ধরে যুদ্ধবিমান ক্রয় করছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই আগামী ৪ ও ৫ ডিসেম্বর ভারত সফর করবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সফরকালে ২৩তম ভারত–রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে রুশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন তিনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা নিশ্চিত করেছে। ক্রেমলিন জানিয়েছে, নয়াদিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দুই দেশের “বিশেষ কৌশলগত অংশীদারিত্ব”–এর সব দিক নিয়ে আলোচনা করবেন পুতিন। ক্রেমলিন সূত্র বলেছে, এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফরটি বিশেষ কৌশলগত অংশীদারত্ব হিসেবে রাশিয়া–ভারত সম্পর্কের বিস্তৃত এজেন্ডা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সুযোগ করে দেবে।

আগেই বলেছি, রাশিয়ার তেলের এক প্রধান ক্রেতা ভারত। কয়েক দশক ধরে রুশ অস্ত্রও কিনে আসছে নয়াদিল্লি। ক্রেমলিন জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সফরকালে মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন পুতিন। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এ সময় দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বাণিজ্যিক নথিতে সই হতে পারে। এদিকে ভারত ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা, “বিশেষ কৌশলগত অংশীদারিত্ব” জোরদারকরণ এবং পারস্পরিক স্বার্থের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়গুলো নিয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

এদিকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পারদ উচ্চ পর্যায়ে। আদিয়ালা জেল সুপারিনটেনডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করার আবেদন করেছেন ইমরানের বোন আলিমা। বেশ কিছুদিন ধরে ইমরান খানের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে দাবি উঠেছে। ইমরান খান কি জীবিত—এর প্রমাণ চাইছেন তার ছেলে কাসিম খান। পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে সেটি চিন্তার বিষয়। সপ্তাহে হানা দেওয়া ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া। শ্রীলঙ্কায় প্রাণহানি প্রায় ৩৩৪ জন। ভারতের জাতীয় দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া বাহিনীর কর্মীরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে শ্রীলঙ্কায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি তথা ভারতীয় জনগণ। উচ্চ বিলাসী স্থাপনায় অর্থ যোগান দিতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত—দেশটিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটি কঠিন অবস্থা থেকে উদ্ধার করে বিগত দিনে যে সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা শ্রীলঙ্কার জনগণ মনে রেখেছে। এই দুর্যোগে হাত বাড়িয়েছে পাকিস্তানও। বাংলাদেশ সরকারও প্রস্তুত রয়েছে সহযোগিতার জন্য। দুর্যোগে বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। এই দুর্যোগ কেটে যাবে—এই প্রত্যাশা।

রাজনীতিতে পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক বিষয়। কূটনীতিতে সমাপ্তি বক্তব্য বলে কোনো শব্দ নেই। চীন মোংলা বন্দর নিয়ে আগ্রহ দেখালেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটাই সরে যাচ্ছে। মোংলা বন্দরের ৭৫ বছরে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে সেটিও ভাবতে হবে। আবার আসা যাক মস্কোর এই দিল্লি সফরে—এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন এমন কোনো বার্তা দিতে চান যার ফলশ্রুতিতে ভূ–রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেও চায় এশিয়ায় তার যে আধিপত্যবাদ সেটি রক্ষা করতে। বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও প্রেসিডেন্টের বক্তব্য অনেকটাই ওলট-পালট করে দিচ্ছে সবকিছু। আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে—আগামী দিনগুলিতে কী ঘটতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রোগশয্যায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। দেশবাসী তাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। সর্বশক্তিমান মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলে প্রার্থনা করছেন তিনি যেন সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসেন। এই লেখার মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট বার্তা দিয়েছেন। তিনি বার্তায় বলেছেন, “বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে জেনে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। দীর্ঘ অনেক বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের জনজীবনে অবদান রেখেছেন। তাঁর দ্রুত আরোগ্যলাভের জন্য আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা ও শুভকামনা রইল। আমরা যেভাবে পারি, সম্ভাব্য সবধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত।” —মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

আমাদের প্রত্যাশা—মুক্তিকামী মানুষের পাশে যেভাবে ভারত ছিল, ঠিক সেভাবেই ভারত আমাদের পাশে থাকবে এবং বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়াবে। বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, মানুষের অধিকারের কথা বলবেন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকারের কথা বলবেন এবং দেশ গঠনে দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন—এটাই প্রত্যাশা।

ডিসেম্বর আমাদের বিজয় ও গৌরবের মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালে ভারত যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেজন্য আমরা সকলে মিত্রবাহিনী আর আমাদের সংগ্রামী, সর্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। যৌথ প্রয়াসে আমরা বিজয় লাভ করেছিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *