শুক্রবার, মার্চ ১৪

রমাদান মাসের ১ম জুমু‘আর খুতবা

আহকামে সিয়াম ও কিয়াম

|| ড. আবু তুরাব মুশতাক আহমাদ ||

ভূমিকা

إنَّ الْحَمْدَ للهِ نَحْمَدُهٗ وَنَسْتَعِيْنُهٗ وَنَسْتَغْفِرُهٗ وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهٗ وَمَنْ يُّضْلِلْهُ فَلاَ هَادِىَ لَهٗ وَأَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ لاَ شَرِيْكَ لَهٗ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهٗ وَرَسُوْلُهٗ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَعَلٰى اٰلِه وَ اَصْحَابِه وَ بَارَكَ وَ سَلَّمَ أَمَّا بَعْدُ! فَقَدْ قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَ تَعَالٰى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ وَ قَالَ رَسُوْلُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه. فيٰۤا اَيُّهَا الْحَاضِرُوْنَ رَحِمَكُمُ اللهُ.
মুয়াজ্জাজ মুহতারাম, আমরা সর্বপ্রথম আল্লাহর শুকরিয়া ও রাসূলুল্লাহ স. এর প্রতি দরুদ পাঠ করছি।

ইসলাম পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সিয়াম তার মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দাদেরকে গণনার জন্য যে বারটি চন্দ্র মাস দান করেছেন, তার মধ্যে বিশেষ সম্মানিত মাস হচ্ছে রমাদান। উম্মতে মুহাম্মদীর উপর রমাদানের পূর্ণমাস সিয়াম পালনকে ফরয করা হয়েছে। রমাদান কুরআনের মাস। রমাদানেই পবিত্র কুরআন মাজীদসহ সকল আসমানী গ্রন্থ নাযিল করা হয়েছে। আজকের খুতবার আলোচ্য বিষয়, ‘আহকামে সিয়াম ও কিয়াম’।

রমাদান ও সিয়ামের পরিচয়
ইসলামী বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৯ম মাসের নাম ‘রমাদান’ (رَمَضَانٌ)। শব্দটি আরবি, এর শাব্দিক অর্থ পোড়ানো, দহন করা, দগ্ধিভূত করা। রমাদানের সিয়ামের মাধ্যমে রোযাদারের পাপরাশি দগ্ধিভূত হয় এবং আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধি লাভ করে। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে রমাদান। সাওম (صَوْمٌ) শব্দটি একবচন, বহুবচনে সিয়াম। অর্থ বিরত থাকা, বিশ্রাম নেয়া, আরাম করা, কঠোর সাধনা করা, অবিরাম প্রচেষ্টা করা। আর পারিভাষিক সংজ্ঞা হলো, আল্লাহ্র নির্দেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার, জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সকল পাপাচার থেকে বিরত থাকার নাম সাওম। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ.
তোমারা খাও এবং পান কর, যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অত:পর সিয়াম পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। (সূরা আল-বাক্বারা, ২ : ১৮৭)

সূফী দার্শনিকগণ মনে করেন, رَمَضَانٌ শব্দের অর্থের মধ্যেই তার মাহাত্ম নিহিত। যেমন: رَمَضَانٌ শব্দেরر অক্ষর দ্বারা رِضَاءُ رَبٍّ বা প্রভুর সন্তুষ্টি م অক্ষর দ্বারা مَحَبْةُ اِلَي اللهِ বা আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা, ض অক্ষর দ্বারা ضَامِنٌ لِلْجَنَّةِ বা জান্নাতের জামিনদার। অক্ষর দ্বারা أُلْفَةُ اِلَهٍ বা আল্লাহ্র বন্ধুত্ব এবং ن অক্ষর দ্বারা نُوْرُ اللهِ বা আল্লাহ্র জ্যোতি বুঝায়।
সিয়ামের ইতিহাস

আত্মার পরিশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, পাশবিক প্রবৃত্তি দমনের মাধ্যমে মানবিক মমতাবোধের বিকাশ, সততা ও তাক্বওয়া অর্জনের জন্য সকল যুগের সকল বিশ্বাসী মানুষের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিলো সিয়াম। মানব সমাজে সিয়ামের প্রথা বা ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসের মতোই অতি প্রাচীন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সাওম ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী (তাক্বওয়া) অর্জন করতে পার। (সূরা আল-বাক্বারা, ২ : ১৮৩)

পূর্ববর্তী অন্যান্য উম্মতের উপর কিভাবে কতদিনের জন্য তা প্রচলিত ছিল তার কোন বিস্তারিত বর্ণনা কুরআনে দেখা যায় না। তবে হাদিস ও প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে জানা যায়, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আদম আ. চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ (আইয়্যামে বীজের) তারিখে সিয়াম পালন করেন।
নূহ আ. ‘ইয়াওমুল ফিতর’ ও ‘ইয়াওমুল আযহা’ ছাড়া প্রায় সারা বছরই সাওম পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
صَامَ نُوحٌ الدَّهْرَ إِلَّا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الْأَضْحَى.
নূহ আ. ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত সারা বছর সিয়াম পালন করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ্-১৭১৪ ইফা)

মূসা আ. ৪০ দিন সাওম পালন করে তূর পাহাড়ে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করেন। এছাড়াও ১০ মুর্হারম তারিখে আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সাওম পালন করেন। হাদিসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدِمَ الْمَدِينَةِ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ فَقَالُوا هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللّٰهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُومُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَي مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمَرَ بِصِيَامِه.
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন ইয়াহুদীদেরকে তিনি আশুরার সিয়াম রাখতে দেখলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী দিন যাতে তোমরা সিয়াম রেখেছ? তারা বলল, এটা মহৎ একটি দিন, আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে মূসা আ. ও তাঁর কাওমকে (বানী ইসরাঈলকে) মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরআউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তাই মূসা আ. শুকরিয়াস্বরূপ এ দিনে সিয়াম রেখেছিলেন আর মূসা আ. এর অনুসারী হিসেবে আমরাও সিয়াম রাখি। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ স. বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরাই মূসা আ. এর প্রতি বেশি হকদার। তারপর রাসূলুল্লাহ স. নিজেও এ দিনে সিয়াম রাখলেন এবং তাঁর উম্মতদেরকেও এদিনে সিয়াম পালনের আদেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি-১৮৭৮ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫২৯ ইফা)

দাউদ আ. একদিন পর একদিন সাওম পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عَنْ عَمْرِو بْنِ أَوْسٍ الثَّقَفِيِّ سَمِعَ عَبْدَ اللّٰهِ بْنَ عَمْرٍو قَالَ قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَبُّ الصِّيَامِ إِلَى اللّٰهِ صِيَامُ دَاوُدَ كَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا وَأَحَبُّ الصَّلاَةِ إِلَى اللّٰهِ صَلاَةُ دَاوُدَ كَانَ يَنَامُ نِصْفَ اللَّيْلِ وَيَقُومُ ثُلُثَهُ وَيَنَامُ سُدُسَهُ.
সিয়ামসমূহের মধ্যে দাউদ আ. এর সিয়াম আল্লাহ্র নিকট অধিক প্রিয়। তিনি একদিন সিয়াম রাখতেন এবং পরবর্তী দিন সিয়াম রাখতেন না। আল্লাহ্র নিকট দাঊদ আ. এর সালাত অধিক প্রিয়। তিনি রাতের অর্ধাংশ ঘুমাতেন, এক তৃতীয়াংশ সালাতে কাটাতেন এবং আবার এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। (সহিহ বুখারি-৩১৮০ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৬১০ ইফা)

ঈসা আ. মরুভূমিতে চল্লিশ দিন সাওম পালন করেন। তাছাড়া ঈসা আ. জন্মের পূর্বে তাঁর মা মারইয়ামও আ. সাওম পালন করেছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَٰنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا.
তাদের বলে দাও, আমি আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সাওম মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। (সূরা মারইয়াম, ১৯ : ২৬)

রাসূলুল্লাহ্ স. যখন মদীনায় আগমন করেন তখন তিনি প্রতি মাসে তিনটি এবং আশূরার সিয়াম রাখতেন। অত:পর দ্বিতীয় হিজরীতে রমাদানের সিয়াম ফরজ করা হলে, তখন তা নফলে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عن عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُ بِصِيَامِه قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ مَنْ شَاءَ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَمَنْ شَاءَ أَفْطَرَ.
আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. রমাদানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্বে আশূরার সিয়াম রাখার আদেশ করেন। অত:পর যখন রমাদানের সিয়াম ফরজ হয় তখন তা ঐচ্ছিক তথা যার ইচ্ছা সে রাখবে এবং যার ইচ্ছা সে ছেড়ে দিবে। (সহিহ মুসলিম-২৫১১ ইফা)
كَانَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِى الْحِجَّةِ وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ وَثَلاَثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ أَوَّلَ اثْنَيْنِ مِنَ الشَّهْرِ وَالْخَمِيسَ.
রাসূলুল্লাহ স. যিলহাজ্জ মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত, আশুরার দিন, প্রত্যেক মাসে তিন দিন, মাসের প্রথম সোমবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করতেন। (সুনানে আবু দাউদ-২৪২৯ ইফা)

সিয়ামের শর‘ঈ বিধান
প্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলমান নর-নারীর উপর রমাদানের পূর্ণমাস সিয়াম পালন ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ.
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সাওম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্যে। তোমাদের মধ্যে কেই অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে।

আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করা। যে ব্যক্তি স্বত:স্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণের যদি তোমরা জানতে। (সূরা আল-বাক্বারা, ২ : ১৮৩-১৮৪)

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ.
রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। (সূরা আল-বাক্বারা, ২ : ১৮৫)

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
اِتَّقُوْا اللهَ وَصَلُّوْا خَمْسَكُمْ وَصُوْمُوْا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوْا زَكاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيْعُوْا أُمَرَاءَكُمْ تَدْخُلُوْا جَنَّةَ رَبِّكُمْ.
তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় কর, রমাদানের সিয়াম পালন কর, তোমাদের সম্পদের যাকাত আদায় কর, তোমাদের শাসকদের আনুগত্য কর তাহলেই তোমাদের প্রভূর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (সুনানে তিরমিযি-৬১৪ ইফা)

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসের আলোকে সাব্যস্ত হয় যে, রমাদানের সিয়াম উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর ফরয। সুতরাং এ ফরযিয়াতকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।

সিয়ামের ফজিলত

ক. রামাদান সাওয়াব সংগ্রহের মাস:
হাদিসে এসেছে,
عَن أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتْ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَيُنَادِي مُنَادٍ يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلّٰهِ عُتَقَاءُ مِنْ النَّارِ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, শয়তান ও দুষ্ট জিনদের রামাদান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং একটি দরজাও তখন আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও, হে মন্দ অন্বেষণকারী! থাম। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে এ মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। (সুনানে তিরমিযি-৬৭৯ ইফা)

খ. সিয়াম পালনের মাধ্যমে শরীরের যাকাত আদায় হয়:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِكُلِّ شَيْءٍ زَكَاةٌ وَزَكَاةُ الْجَسَدِ الصَّوْم.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, প্রত্যেক জিনিসের যাকাত রয়েছে আর শরীরের যাকাত হলো সিয়াম। (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৭৪৫ ইফা)

গ. রোজাদারদেরকে বিশেষ পাঁচটি জিনিস দান করা হয়:
হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُعْطِيَتْ أُمَّتِي خَمْسَ خِصَالٍ فِي رَمَضَانَ لَمْ تُعْطَهَا أُمَّةٌ قَبْلَهُمْ خُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ الِلّٰهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ وَتَسْتَغْفِرُ لَهُمْ الْمَلَائِكَةُ حَتَّى يُفْطِرُوا وَيُزَيِّنُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلَّ يَوْمٍ جَنَّتَهُ ثُمَّ يَقُولُ يُوشِكُ عِبَادِي الصَّالِحُونَ أَنْ يُلْقُوا عَنْهُمْ الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى وَيَصِيرُوا إِلَيْكِ وَيُصَفَّدُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ فَلَا يَخْلُصُوا إِلَى مَا كَانُوا يَخْلُصُونَ إِلَيْهِ فِي غَيْرِهِ وَيُغْفَرُ لَهُمْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ قِيلَ يَا رَسُولَ الِلّٰهِ أَهِيَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ قَالَ لَا وَلَكِنَّ الْعَامِلَ إِنَّمَا يُوَفَّى أَجْرَهُ إِذَا قَضَى عَمَلَهُ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আমার উম্মতকে রমাদানে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তীদেরকে দান করা হয় নি। ১. রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষাও উত্তম। ২. তারা যতক্ষণ না ইফতার করে ততক্ষণ ফিরিশতাগণ তার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন। ৩. আল্লাহ প্রতিদিন তাদের জন্য জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন। ৪. এ মাসে শয়তানদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। ৫. আর নেক বান্দাদের জন্য শেষ রাত্রে মাগফিরাত দান করা হয়। রাসূলুল্লাহ স. কে জিজ্ঞেস করা হল, সেটা কি লাইলাতুল কদরের কথা! তিনি বললেন, না। বরং আমলকারী যখন তার আমল সম্পূর্ণ করবে, তখন তার প্রতিফল তাকে পুরোপুরি আদায় করে দেয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ-৭৫৭৬)

ঘ. সিয়ামের প্রতিদান আল্লাহ তা‘আলা নিজেই দিবেন:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ.
আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, বনী আদমের প্রতিটি আমলের সাওয়াব আল্লাহর ইচ্ছায় দশ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ বলেন, সিয়াম ব্যতীত। কেননা সিয়াম আমার জন্যই আর আমি নিজেই তার প্রতিদান দিব। সে তার জৈবিক চাহিদা ও পানাহার পরিহার করেছে। (সহিহ মুসলিম-২৫৭৮ ইফা; সুনানে ইবনে মাজাহ-১৬৩৮ ইফা)

ঙ. পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عن أبي هريرة قال قال رَسُولَ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি-১৭৮০ ইফা; সহিহ মুসলিম-১৬৫৪ ইফা)

চ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়:
রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ الِلّٰهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا.
যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন সিয়াম রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরে সরিয়ে দিবেন। (সহিহ বুখারি-২৬৪৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫৮৪ ইফা)

ছ. সিয়াম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে:
হাদিসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ الِلّٰهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ.
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, সিয়াম এবং কুরআন কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে দিনে খাদ্য গ্রহণ এবং জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অত:পর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ-৬৬২৬)

জ. বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ:
সাওম পালনকারীর মর্যাদা প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ سَهْلٍ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ‏ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.
সাহল ইবনে সা’দ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যার নাম ‘রাইয়্যান’। কিয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীগণ এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। ঘোষণা দেয়া হবে সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে, তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে, অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (সহিহ বুখারি-৩০২৯ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫৮১ ইফা)

ঝ. ইফতার করালে রোজাদারের সমান সাওয়াব পাওয়া যায়:
হাদিসে এসেছে,
عَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِمْ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا.
যায়েদ ইবনে খালেদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায় সেও রোযাদারের সমান সাওয়াব পাবে অথচ রোযাদারের সাওয়াব কমতি করা হয় না। (সুনানে তিরমিযি-৮০৫ ইফা; সুনানে ইবনে মাজাহ-১৭৪৬ ইফা)

ঞ. সিয়াম ঢাল স্বরূপ:
যুদ্ধের ময়দানে ঢাল যেমন শত্রæর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে তেমনি রোজাদারকে গুনাহ্ থেকে রক্ষা করে সিয়াম। হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصِّيَامُ جُنَّةٌ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, সিয়াম ঢাল স্বরূপ। (সহিহ বুখারি-১৭৭৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫৭৬ ইফা)

সিয়াম ও কিয়াম সংক্রান্ত কিছু বিধান

রমাদান মাস ইবাদাতের বসন্ত। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সফল একটি রমাদান কাটানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়ের বিধান জানা ও আমলের প্রতি যত্নশীল হওয়া একান্ত দরকার।

সাওমের নিয়্যাত করা

নিয়ত অর্থ ইচ্ছা করা। মনে মনে এ ইচ্ছা করা যে, আগামীকাল আমি সিয়াম পালন করবো। সিয়াম পালনের এ সিদ্ধান্তই হল সাওমের নিয়্যাত। অবশ্য সাহরী খাওয়াও নিয়তের শামিল বা স্থলাভিষিক্ত। নিয়্যাত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,
عَنْ حَفْصَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ لَمْ يُجْمِعِ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ فَلَا صِيَامَ لَهُ.
হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে ব্যক্তি সুবহি সাদিকের পূর্বে সাওমের নিয়ত করেনি তার সাওম আদায় হবে না। (সুনানে তিরমিযি-৭২৮ ইফা; সুনানে আবু দাউদ-২৪৪৬ ইফা)

সাহরী গ্রহন করা

সাহরী খাওয়া সুন্নত। অর্ধরাত্রির পর সাওমের নিয়্যাতে কোন কিছু পানাহার করাকে ইসলামের দৃষ্টিতে সাহরী বলে। হাদিসে এসেছে,
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ.
আমর ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও নাসারা) এবং আমাদের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে সাহরী খাওয়া। (সহিহ মুসলিম-২৪২১ ইফা)
সাহরী খাওয়া খুবই বরকত ও মঙ্গলের কারণ। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী করা। সাহরী শেষ সময়ে খাওয়া সুন্নাত। হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بركَة.
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরী খাওয়ার মধ্যে রয়েছে বরকত। (সহিহ বুখারি-১৮০১ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৪২০ ইফা)
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَزَالُ أُمَّتِي بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْإِفْطَارَ وَأَخَّرُوا السُّحُورَ.
আবু জার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আমার উম্মতেরা ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতক্ষণ তারা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে এবং সাহরী করবে বিলম্বে। (মুসনাদে আহমাদ-২১৩১২)
عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ قَامَ إِلَى الصَّلاَةِ ‏‏ قُلْتُ كَمْ كَانَ بَيْنَ الأَذَانِ وَالسَّحُورِ قَالَ قَدْرُ خَمْسِينَ آيَةً.
যায়েদ ইবন সাবিত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ স. এর সাথে সাহরী খেতাম, এরপরই তিনি ফজরের সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম: সাহরী খাওয়া এবং ফজরের আযানের মধ্যে কতটুকু সময়ের ব্যবধান? তিনি বলেন, কুরআনের পঞ্চাশটি আয়াত তিলাওয়াত করা পরিমান সময়। (সহিহ বুখারি-১৭৯৯ ইফা)

ইফতার করা

ইফতার করা সুন্নাত। যে কোন হালাল খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ইফতার করলেই সুন্নাহ আদায় হয়ে যাবে। তবে খেজুর দ্বারা ইফতার করা উত্তম। হাদীসে এসেছে,
عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَفْطَرَ أَحَدُكُمْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى تَمْرٍ فَإِنَّهُ بَرَكَةٌ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى مَاءٍ فَإِنَّهُ طَهُورٌ.
যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। যদি খেজুর না পায় তাহলে যেন ইফতার করে পানি দ্বারা, কেননা পানি পবিত্র। (সুনানে তিরমিযি-৬৯৩ ইফা; আবু দাউদ-২৩৪৭ ইফা)
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ ‏”‏ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ عَلَى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَتُمَيْرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمَيْرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ.
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. (মাগরিবের) সালাত আদায়ের পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না পেতেন তবে শুকনা খেজুর দ্বারা; যদি শুকনা খেজুরও না থাকত তবে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন। (সুনানে তিরমিযি-৬৯৪ ইফা; সুনানে আবু দাউদ-২৩৪৮ ইফা)

তাড়াতাড়ি ইফতার করা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عَنْ سَهْلٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ.
লোকেরা যতদিন ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। (সহিহ বুখারি-১৮৩৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৪২৫ ইফা)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ.
দ্বীন ততদিন পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে, যতদিন মানুষেরা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা ইয়াহুদী ও নাসারারা ইফতার বিলম্বে করে থাকে। (সনানে আবু দাউদ-২৩৪৫ ইফা)

ইফতারের সময় দু’আ করা:

যদিও ইফতারের সময় দু’আ পাঠ করা সিয়াম সহিহ হওয়ার জন্য শর্ত নয়, তবে এটা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ স. পাঠ করতেন,
اَللّٰهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ.
হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়েই ইফতার করছি। (সুনানে আবূ দাউদ-২৩৫০ ইফা)

ভুলক্রমে পানাহার করলে রোজার কোন ক্ষতি হয় না। হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ نَسِيَ وَهُوَ صَائِمٌ فأل أَوْ شَرِبَ فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ فَإِنَّمَا أَطْعَمَهُ اللّٰهُ وَسَقَاهٗ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, রোজাদার ভুলক্রমে যদি আহার করে বা পান করে ফেলে, তাহলে সে যেন তার রোজাকে পূর্ণ করে নেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন। (সহিহ বুখারি-১৮০৯ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫৮৭ ইফা)

সালাতুত তারাবীহ

সিয়াম পালনের সাথে সাথে সালাতুত তারাবীহ এর প্রতি আন্তরিক হওয়া ও বেশী বেশী নফল, মুস্তাহাব ইবাদাত করা। ‘তারাবীহ’ এর শাব্দিক অর্থ হলো বিশ্রাম করা। এ সালাত বিশ্রাম নিয়ে ধীরস্থিরভাবে পড়া। তারাবীহর সালাত নারী-পুরুষ সবার জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عَنِ النَّضْرِ بْنِ شَيْبَانَ قَالَ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرَ شَهْرَ رَمَضَانَ فَقَالَ شَهْرٌ كَتَبَ اللّٰهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ وَسَنَنْتُ لَكُمْ قِيَامَهُ فَمَنْ صَامَهُ وَقَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِهِ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ.
আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের উপর রমাদানের সিয়াম ফরয করেছেন এবং আমি তোমাদের জন্য কিয়ামুল লাইলকে সুন্নাত করেছি। অতএব, যে ব্যক্তি রমাদানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় সিয়াম পালন করে এবং কিয়ামুল লাইল আদায় করে, তার গুনাহগুলো মুছে সে দিনের ন্যয় নিস্পাপ হয়ে যায়, যে দিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। (সুনানে নাসাঈ-২২১৪ ইফা; সুনানে ইবনে মাজাহ-১৩২৮ ইফা)
جَعَلَ اللهُ صِيَامَهُ فَرِيضَةً وَقِيَامَ لَيْلِهِ تَطَوُّعًا
আল্লাহ তা‘আলা এ মাসের সিয়াম তোমাদের উপর ফরয করেছেন এবং রাতে সালাত (তারাবীহ) পড়া নফল করেছেন। (বাইহাকী-৩৩৩৬; মিশকাত-১৯৬৫)

কিয়ামুল লাইল

‘কিয়ামুল লাইল’ এর মূল সুন্নাত হলো সালাতে দাড়িয়ে তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ স. রমাদান ও রমাদানের বাইরে প্রতি রাতে মধ্য রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ৪/৫ ঘন্টা ধরে ‘কিয়ামুল লাইল’ করতেন। তিনি এতো লম্বা কিরাআত ও দীর্ঘ রুকু-সাজদা করতেন যে, অনেক সময় ২/৪ রাকাতেই এ দীর্ঘ ৪/৫ ঘন্টা শেষ হতো। বর্তমানে আমরা কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের চেয়ে সংখ্যা গণনা করা ও তাড়াতাড়ি শেষ করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। অনেকে আবার ৮/১০ রাকাত পড়েই চলে যান। অথচ রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন,
قَالَ إِنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الْإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كَتَبَ اللّٰهُ لَهُ قِيَامَ لَيْلَةٍ.
যদি কেউ ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত তারাবীহ আদায় করে তবে সে সারারাত ‘কিয়ামুল লাইলের’ সাওয়াব লাভ করবে। (সুনানে তিরমিযি-৮০৪ ইফা)
‘কিয়ামুল লাইল’ এর ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে ব্যক্তি রমাদানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় কিয়ামুল লাইল করল, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহিহ বুখারি-১৮৮৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-১৬৫৩ ইফা)

সালাতুত তারাবীহতে রাকাত সংখ্যার চেয়ে অধিক সময় ব্যয় করাই মূখ্য বিষয়: মূলত তারাবীহর মূল বিষয় হলো লম্বা কিয়ামে সালাত আদায় করা অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আদায় করা করা।
বর্তমানে আমাদের দেশে এই সালাতের রাকাত সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে; এমনকি এ নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হতেও দেখা যায়। মূলবিষয় হচ্ছে আপনি ইমামের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিয়াম করবেন তা ৮ রাকাত হোক বা ২০ রাকাত হোক। এখানে রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিভেদ সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই; কেননা রাসূলুল্লাহ স. রাকাতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি বরং তা উন্মুক্ত রেখেছেন। তবে আমাদের দেশে যেভাবে দ্রæতবেগে তিলাওয়াত করে তারাবীহ আদায় করা হয় তা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয় এবং তা সুন্নাহর খেলাপ। কত সময় এবং কত সুন্দরভাবে আপনি এই সালাত আদায় করছেন এটাই মুখ্য, রাকাতের সংখ্যা মুখ্য বিষয় নয়।

তারাবীর জন্য রোজাদার হওয়া শর্ত নয়: রোজা ও তারাবীহ দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ইবাদত, একটির সাথে আরেকটি সম্পৃক্ত নয়। কাজেই কেউ যদি কোন কারণে রোজা না রাখতে পারে তাহলে তার উপর থেকে তারাবীর সালাত মাফ হয়ে যায় না। তারাবীর জন্য সে পৃথকভাবে দায়বদ্ধ। অর্থাৎ তারাবীর জন্য রোজা শর্ত নয়। (আপনাদের প্রশ্নের জবাব, খ. ১, প্রশ্ন নং-৮৮৭)
সিয়ামরত অবস্থায় গীবত ও মিথ্যা কথা না বলা প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ ত্যাগ করে না, তার খানাপিনা বন্ধ রাখাতে আল্লাহ্ তা‘আলার কোন প্রয়োজন নেই। (সহিহ বুখারি-১৭৮২ ইফা)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, কত রোজাদার আছে যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত্র জাগরণ করা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। (সুনানে ইবন মাজাহ-১৬৯০ ইফা)

আলোচনার সারনির্যাস

ক. রমাদানে রয়েছে অবারিত ফজিলত:
রমাদান সাওয়াব সংগ্রহের মাস; সিয়াম পালনের মাধ্যমে শরীরের যাকাত আদায় হয়; সিয়ামের প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজেই; পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়; জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়; সিয়াম কিয়ামতের দিন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করবে; বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে এবং রোযাদারকে ইফতার করালে রোজাদারের সমান সাওয়াব পাওয়া যাবে।

খ. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা:
রমাদান কুরআন নাযিলের মাস। কাজেই আমরা কুরআন অধ্যয়ন করবো ও বুঝে বুঝে পড়বো। হাদিসে এসেছে,
عَن أبي هُرَيْرَة قَالَ كَانَ يعرض على النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِي الْعَامِ الَّذِي قُبِضَ وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلَّ عَامٍ عَشْرًا فَاعْتَكَفَ عِشْرِينَ فِي الْعَامِ الَّذِي قُبِضَ.
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রতি বছর জিবরাঈল আ. রাসূলুল্লাহ্ স. এর সাথে একবার কুরআন খতম করতেন। কিন্তু যে বছর রাসূলুল্লাহ স. ওফাত লাভ করেন সে বছর তিনি রাসূলুল্লাহ স. এর সঙ্গে দু’বার খতম করেন। প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ স. দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ওফাত লাভ করেন সে বছর তিনি বিশ দিন ই’তিকাফ করেন। (সহিহ বুখারি-৪৬৩২ ইফা)

গ. বেশি বেশি দান-সদাকা করা:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ فَلَرَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَة.
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. দানশীলতায় সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। অন্য সময়ের চেয়ে রমাদান মাসে তার দানশীলতা অত্যধিক হতো। জিবরাঈল আ. প্রতি বছর রমাদান মাসে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। রমাদান শেষ হওয়া পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ স. তার সামনে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন। যখন জিবরাঈল আ. তার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও অধিক দান করতেন। (সহিহ বুখারি-৫ ইফা; সহিহ মুসলিম-৫৮০৪ ইফা)

ঘ. সময়মতো সাহরী-ইফতার করা:
রাসূলুল্লাহ স. এর সুন্নাত সুর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। সাহাবাগণও সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করতেন। হাদিসে এসেছে,
عَنْ سَهْلٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ.
লোকেরা যতদিন ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। (সহিহ বুখারি-১৮৩৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৪২৫ ইফা)

সাহরী খাওয়া ইবাদাত:

সাহরীর নির্দেশ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلَا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ.
আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, সাহরী খাওয়া বরকত; কাজেই তোমরা তা ছাড়বে না। যদি এক ঢোক পানি পান করেও হয় তবুও; কারণ যারা সাহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ ও তার ফিরিশতাগণ দু’আ করতে থাকেন। (মুসনাদে আহমাদ-১১০৮৬)

ইফতারের পূর্ব মুহুর্তে দু’আ কবুল করা হয় প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ الصَّائِمُ حِينَ يُفْطِرُ وَالْإِمَامُ الْعَادِلُ وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ.
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, তিন শ্রেণির লোকের দু’আ কখনও প্রত্যাখ্যান করা হয় না। রোজাদারের দু’আ যখন তিনি ইফতার করেন, ন্যায়-পরায়ণ শাসকের দু’আ এবং নির্যাতিত (মাযলুম) ব্যক্তির দু’আ। (সুনানে তিরমিযি-২৫২৮ ইফা; মুসনাদে আহমাদ-৮০৪৩)
لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ وَلَخُلُوفِ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ الِلّٰهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ.
সাওমপালনকারী ব্যক্তির জন্য দু‘টি খুশির বিষয়। একটি খুশি ইফতারের সময়, আরেকটি খুশি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়। সাওমের কারণে যে দুর্গন্ধ হয় তা, আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক উৎকৃষ্ট। (সহিহ বুখারি-৬৯৮৪ ইফা; সহিহ মুসলিম-২৫৭৮ ইফা)

ঙ. ফরজ সালাতসহ তারাবীহ ও নফল ইবাদাতের প্রতি আন্তরিক হওয়া:
রমাদানে সিয়াম পালনের সাথে সাথে ফরজ সালাতসহ তারাবীহ সালাতের প্রতি আন্তরিক হওয়া ও বেশী বেশী নফল, মুস্তাহাব ইবাদাত করা। ‘কিয়ামুল লাইল’ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ স. বলেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
যে ব্যক্তি রমাদানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় কিয়ামুল লাইল করল, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহিহ বুখারি-১৮৮৩ ইফা; সহিহ মুসলিম-১৬৫৩ ইফা)

চ. বেশি বেশি নেক আমল করা:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ.
আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, বানী আদমের প্রতিটি আমলের সাওয়াব আল্লাহর ইচ্ছায় দশ থেকে সাতশ গুণে বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ বলেন, সিয়াম ব্যতীত। কেননা সিয়াম আমার জন্যই আর আমি নিজেই তার প্রতিদান দিব। সে তার জৈবিক চাহিদা ও পানাহার পরিহার করেছে। (সহিহ মুসলিম-২৫৭৮ ইফা; সুনানে ইবনে মাজাহ-১৬৩৮ ইফা)

ছ. সকল প্রকার অন্যায় পরিহার করা:
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, কত রোজাদার আছে যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত্র জাগরণ করা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। (সুনানে ইবন মাজাহ-১৬৯০ ইফা)

উপসংহার

সিয়াম এমন এক ইবাদাত যা থেকে মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আত্মা সকলেই সমভাবে ফায়দা হাসিল করে। অতিভোজন নিয়ন্ত্রণ, আত্মিক রোগ থেকে আত্মশুদ্ধির সুব্যবস্থাও বটে। আর মহাগ্রন্থ কুরআন হচ্ছে আমাদের পথনির্দেশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস। তাই জীবনকে সুন্দর ও সৌন্দর্যময় করে গড়ে তুলতে এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করতে কুরআনের শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। একটি হাদিস বলেই আজকের আলোচনা শেষ করবো ইনশাআল্লাহ,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ الِلّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ.
রাসূলুল্লাহ স. বলেন, ঐ ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক, যার নিকট আমার নাম উচ্চারণ করা হয় অথচ সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে না। ঐ ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক যে রমাদান পেল অথচ গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি ব্যতিতই রমাদান বিদায় নিল। ঐ ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক যে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ তাদের খিদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (সুনানে তিরমিযি-৩৫৪৫ ইফা)
আসুন! মাহে রমাদানে সিয়াম, কিয়াম ও কুরআনের হক আদায় করে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভে ধন্য হই। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: ইমাম ও খতিব, সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেনানিবাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *