|| মো. নুরুল হুদা ||
ভাষা, সংস্কৃতি এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিপ্লব—এই দুটি ঘটনা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘটলেও উভয়ের মধ্যে কিছু মিল ও পার্থক্য বিদ্যমান। এ প্রবন্ধে আমরা দুই ঘটনার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করব।
ভাষা আন্দোলনঃ
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষের ভাষাগত অধিকার খর্ব হতে থাকে। পাকিস্তানের সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, যা বাঙালিরা মেনে নেয়নি। ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নামে। পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। পরবর্তীতে এই আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। সর্বশেষ, এ দিবসটি প্রতি বছর “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হয়।
২০২৪ এর বিপ্লবঃ
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিপ্লব মূলত প্রযুক্তি, গণতন্ত্র, সামাজিক পরিবর্তন ও বৈশ্বিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত। এটি আধুনিক রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের অংশ, যেখানে জনগণ নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের মতো কোনো একক ভাষাভিত্তিক আন্দোলন ছিল না, বরং এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দাবির উপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়েছিল।
মিল
১. অধিকার আদায়ের লড়াইঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা বিপ্লব
উভয় ঘটনাই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালে বাঙালিরা ভাষার অধিকার চেয়েছিল আর ২০২৪ সালের বিপ্লবে জনগণ গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিল।
২. যুব সমাজের অংশগ্রহণঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যেমন ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, তেমনি ২০২৪ সালের বিপ্লবেও তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়।
৩. প্রতিরোধ ও বল প্রয়োগঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল, ঠিক তেমনি ৫ আগস্টের বিপ্লবেও প্রশাসনিক প্রতিরোধ ও দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
অমিল
১. কারণ ও লক্ষ্যঃ
ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মাতৃভাষার স্বীকৃতি, যা একটি সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লব ছিল একটি বহুমাত্রিক আন্দোলন, যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের দাবি ছিল মুখ্য।
প্রযুক্তির ব্যবহারঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রচার-প্রচারণা ছিল মূলত হাতে লেখা লিফলেট ও জনসভাভিত্তিক। কিন্তু ২০২৪ সালের বিপ্লবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রাণহানিঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদ হাতে গোনা কয়েকজন আর ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে প্রায় দেড় হাজারের অধিক শহীদ ও পাঁচ হাজারের অধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত। যারা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
ক্ষমতার ভিতে আঘাতঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ততকালীন পাকিস্তান সরকার দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত হয়। পরিশেষে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রতিরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়।
আন্দোলনের বিস্তার ও প্রভাবঃ
ভাষা আন্দোলন প্রধানত পূর্ব বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এর প্রভাব পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠে। কিন্তু ৫ আগস্টের বিপ্লব সমসাময়িক বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট আন্দোলন হিসেবে গৃহীত হয়।
উপসংহার
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিপ্লব দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হলেও উভয়ের মধ্যে কিছু মৌলিক সাদৃশ্য রয়েছে। উভয় আন্দোলনই জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছে এবং প্রশাসনিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে পরিচালিত হয়েছিল, আর ৫ আগস্টের বিপ্লব ছিল বহুমুখী দাবির প্রতিফলন। ইতিহাসে এসব ঘটনা ভবিষ্যৎ আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে, যেমন ভাষা আন্দোলন করেছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক এবং লেখক ও গবেষক, ঢাকা। রচনাকাল : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।