
|| শেখ শাহরিয়ার | জেলা প্রতিনিধি (খুলনা) |
খুলনা মহানগরীর কেডিএ অ্যাভিনিউ, খান জাহান আলী রোড ও সোনাডাঙ্গা এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই বড় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে পার্কিং সংকট এবং যানজটের তীব্রতার জন্য পরিচিত। এটি শুধু এক ধরনের যানজট নয়, বরং জনস্বাস্থ্য, নগর ব্যবস্থাপনা এবং নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
চিকিৎসা একটি জরুরি সেবা। কিন্তু যখন একজন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন প্রায়ই অ্যাম্বুলেন্স এই জটের শিকার হয়। কেডিএ অ্যাভিনিউতে সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনস্টিক, শান্তিধাম মোড়ের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং গাজী মেডিকেলের সামনে এই দৃশ্য এখন দৈনন্দিন বাস্তবতা।
২০০০ সালের আগে খুলনার বড় হাসপাতালগুলো সীমিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বেসরকারি বিনিয়োগের জোয়ারে সিটি মেডিকেল কলেজ, পপুলার ডায়াগনস্টিক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, গাজী মেডিকেলসহ একের পর এক প্রতিষ্ঠান চালু হয়। তবে তখন কেডিএ বা সিটি করপোরেশন কতটা পার্কিং সুবিধা নিশ্চিত করেছিল তা স্পষ্ট নয়।
বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই নেই নিজস্ব ভূগর্ভস্থ বা বহুতল পার্কিং সুবিধা। ফলে রোগী ও তাদের স্বজনরা বাধ্য হয়ে হাসপাতালের সামনে মূল সড়কে গাড়ি পার্ক করেন। এর ফলস্বরূপ, একদিকে যানজট সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে রোগীরা সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
সবচেয়ে সমস্যাগ্রস্ত এলাকা
কেডিএ অ্যাভিনিউ: সিটি মেডিকেল, পপুলার ডায়াগনস্টিক, প্রিন্স হাসপাতাল ও প্রিন্স ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ অন্যান্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
খান জাহান আলী রোড (শান্তিধাম মোড়): ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
সোনাডাঙ্গা: গাজী মেডিকেল ও একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
ট্রাফিক বিভাগের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই এলাকাগুলোতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। গড়ে প্রতিদিন এইসব স্থানে ৮০–১০০টি ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ১০–১৫টি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকে, যা সড়কের প্রায় ৩০–৪০ শতাংশ দখল করে।
নগরবাসী সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। রাস্তার ধারে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং পথচারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য রাস্তা পার হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া হাসপাতালগুলোর সামনে এভাবে বিশৃঙ্খল পার্কিং হওয়ায় ফুটপাতও দখল হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ ফুটপাত ব্যবহার করে হাঁটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাসিন্দাদের ও ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা
শান্তিধাম মোড়ের বাসিন্দা ও বাড়িওয়ালা মো. কামাল হোসেন বলেন,
“এই হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্কিং এর ফলে সবসময় তীব্র যানজট লেগেই থাকে। অ্যাম্বুলেন্স করে রোগী এলে সড়ক প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়। হাসপাতালের নিজস্ব পার্কিং আছে সেখানে গেলে টাকা দিতে হয়। তাই রোগীরা রাস্তার উপরেই গাড়ি পার্ক করেন।”
কেডিএ এভিনিউ এলাকার মুদি ব্যবসায়ী মোছা. রুবিনা আক্তার বলেন,
“হাসপাতালের সামনে পার্কিং স্বাভাবিক, কিন্তু এখানে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে যানজট লেগেই থাকে। আমার দোকানে মানুষ আসতে পারে না, বেচাকেনা কমে যাচ্ছে।”
হাসপাতালগুলোর রোগী পরিবহনকারী চালক তহিদুল জানান,
“আমি আমার গাড়িতে রোগী নিয়ে এসেছি। হাসপাতালের নিজস্ব পার্কিং সুবিধা না থাকায় রাস্তার উপরই গাড়ি রাখতে হয়। এটা যেমন আমাদের জন্য সমস্যা, তেমনি পথচারী ও অন্যান্য যানবাহনের জন্যও ভোগান্তি।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের অবস্থান
কেডিএ সিটি মেডিকেলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হামিদুল সাহেব মোবাইলে জানান,
“আমাদের হাসপাতালে পার্কিংয়ের জায়গা আছে। তবে রোগীদের গাড়ি যখন একসাথে আসে তখন কিছুটা যানজট তৈরি হয়। আমি আজ ছুটিতে আছি, পরে যোগাযোগ করুন।”
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) সিনিয়র ইনস্পেক্টর মো. মিজানুর রহমান আলোকিত দৈনিককে বলেন,
“আমরা প্রায়ই হাসপাতালগুলোর সামনে অভিযান চালাই। কয়েকদিন যানজট কমে, কিন্তু পরে আবার গাড়ি পার্কিং শুরু হয়। হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের সাথে বারবার কথা হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পালন করে না। জনবল সংকট থাকায় অভিযান চালানোও কঠিন হয়ে পড়েছে।”
ডিভিশনাল স্বাস্থ্য দপ্তরের উপ-পরিচালকের সহকারী মো. মাসুম বিল্লাহ জানান,
“খুলনায় বর্তমানে ২৯৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। অনুমোদন আমরা দিই, তবে পার্কিং বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খুলনার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে পার্কিং সুবিধা রাখা উচিত। এই নিয়ম কার্যকর হলে শুধু নগরীর যানজট কমবে না, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আসা মানুষও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন।
খুলনার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পার্কিং সংকটের সমস্যা একদিকে নগরবাসীর জীবনকে প্রভাবিত করছে, অন্যদিকে জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাই এখনই প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের, যাতে যানজট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো যায় এবং নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।