|| ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ||
‘বখতিয়ার খিলজির পুনরাগমন’
শেখ হাসিনা চার দিনের চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে তৃতীয় দিন ফিরে আসেন। ১৪ জুলাই২০২৪ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে ব্যঙ্গ করলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে আন্দোলনের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ছাত্ররা অভিনব এক শ্লোগান দিল ‘আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার’ ‘তিনি কে উনি কে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’।
বছরের পর বছর ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো দখলে রেখে চাঁদাবাজি, মাস্তানী আর ছাত্রছাত্রী নিপীড়নের আদিম উৎপাত চালাত। সাধারণ ছাত্ররা সেই জিঞ্জির ভেঙে ছাত্রলীগকে তাড়িয়ে দিল, যা ছিল অবিশ্বাস্য। এ পর্যায়ে সরকার আরো ক্ষিপ্ত হয়ে বিরোধী দলীয় নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করল, সর্বত্র কারফিউ জারি করল। ১৬ জুলাই সংহিসতা আরো ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাল রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এর ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববাসী দেখল, বাংলাদেশে সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে ছাত্রদের পাখির মত গুলি করছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সরকার ছাত্রদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। ছাত্ররা জানায়, যে সময় আমাদেরকে ছাত্রলীগ ও পুলিশ দিয়ে পিটানো হচ্ছে, ছররা গুলিতে আমাদের ভাইদের বুক ঝাঁঝরা হচ্ছে সে সময়ে আলোচনার টেবিলে বসার অর্থ হয় না, ফায়সালা হবে রাজপথে। শোনা গেল, হঠাৎ আন্দোলনের প্রথম কাতারের ৬ জন সমন্বয়ক উধাও। জনরোষের ভয়ে ডিবি পুলিশ স্বীকার করল, তাদেরকে ডিবির নিরাপত্তা হেফাযতে রাখা হয়েছে। তখন শিক্ষক বুদ্ধিজীবিরাও আন্দোলনের মাঠে। ডিবি একটি ভিডিও অনলাইনে দিল, তাতে দেখা গেল, বন্দি ছাত্রনেতাদের জামাই আদরে ভাত খাওায়ানো হচ্ছে আর তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। ডিবি পুলিশের মান-ইজ্জত এবার ধুলায় লুটাল। বন্দি ছাত্রনেতারা অনশন শুরু করলে ৩৩ ঘন্টা পর তাদেরকে মুক্তি দিয়ে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হলো। আন্দোলন তখন নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। ছাত্রজনতার এখন একটাই দাবি, শেখ হাসিনার পতন চাই।
এ লেখার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসের এক মহাবিস্ময়কে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিযার খিলজি বাংলা জয় করেছিলেন ১২০৪ সালে ১৭ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে। ইতিহাসের ছাত্রদের প্রশ্ন, মাত্র ১৭জন ঘোড় সওয়ার নিয়ে কি একটি দেশ জয় করা যায়। আসল ব্যাপার ছিল , নানা জুলুম অত্যাচারে ক্ষুব্ধ অতিষ্ট বাংলার জনগণ কোনো মুক্তিদাতার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল। তখনই বখতিয়ার খিলজির আগমনে মুহূর্তে ঘটে গিয়েছিল গণঅভ্যুত্থান। রাজা লক্ষণ সেনের তখন রাজ প্রাসাদের পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
ভবিষ্যত প্রজন্ম বলতে পারবে, বখতিয়ার খিলজি দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে এসেছিলেন দুই হাজার চব্বিশ সালের ৫ আগস্টে।
তার অদৃশ্য ঘোড়ার হ্রেস্বাধ্বনি আমরা শুনতে পেয়েছি এ যুগের লক্ষণ সেনের পলায়নের দিনে জনতার তরঙ্গায়িত গর্জনে শ্লোগানে শ্লোগানে।
হেফাজতের ব্যানারে আলেম সমাজের নেতৃত্বে তওহীদি জনতার গণজাগরণ নির্মমভাবে দমন করেছিলেন তিনি। বিএনপির মত গণমুখী দলের উপর তার দলন দমন ছিল নির্দয়, নিষ্ঠুর। জামায়াতের মত শক্তিশালী দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে উল্লাস করেছিলেন। তবুও এ যুগের লক্ষণ সেনকে ক্ষমতার মসনদ থেকে নামিয়ে দিল্লী পাঠানোর সাধ্য ছিল না কারো। ছাত্রসমাজ সেই অসাধ্য সাধন করেছে, দ্বিতীয়বার বাংলার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
২১ জুলাইর পর শেখ হাসিনা ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা যদি কদিন আগেও দিতেন, ছাত্রদের সাথে যদি আলোচনায় বসতে রাজি হতেন, তাহলে তাদের অবস্থা হয়ত তীর-খাওয়া পাখির মতো হত না। কিন্তু ইতিহাস দাম্ভিক, অত্যাচারীদের ক্ষমা করে না এটিই সত্য। (চলবে….)
লেখক: ইসলামিক স্কলার ও গবেষক এবং ফিচার সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।