
|| শেখ শাহরিয়ার | খুলনা প্রতিনিধি ||
একের পর এক হত্যাকাণ্ড, গুলিবিদ্ধ দেহ, ধর্ষণ ও লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মহানগরীতে। গত ১ মাসেই ১০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত সময়েই নদীখাল ও জনবহুল স্থান থেকে ১৩টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়েছে। অধিকাংশেরই মেলেনি পরিচয়, ফলে মরদেহগুলো বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে হয়েছে। সহিংসতার সর্বশেষ সংযোজন ২৬ জুন রাতে খুলনা শহর ও শহরতলীতে পৃথক স্থানে দু’জন নিহত, দু’জন গুলিবিদ্ধ।
গত ২৬ জুন রাত ৯টার দিকে খুলনার রূপসা উপজেলার রাজাপুর গ্রামে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ২৭বছর বয়সী সাব্বির হোসেন, গুলিবিদ্ধ হন সাদ্দাম হোসেন (২৯) ও মিরাজ ওরফে কাউয়া মিরাজ (২৮)। এরা সবাই খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর সহযোগী।
রূপসা থানার ওসি মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানান, আইচগাতী ইউনিয়নের রাজাপুরের পপুলার এলাকার সোহাগের বাড়িতে খুলনার কুখ্যাত গ্রেনেড বাবু গ্রুপ গোপন মিটিং করছিল, এমন তথ্য পেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আশিক গ্রুপ সেখানে গুলি চালায়। এতে সাব্বির ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত সাদ্দামকে খুলনা মেডিক্যাল থেকে শনাক্ত করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। মিরাজ চিকিৎসা না নিয়েই পালিয়ে আত্মগোপনে আছে।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৬টি খালি কার্তুজ, ৪টি অস্ত্রের গুলি, ইয়াবা ট্যাবলেট ও গ্রেনেড সদৃশ একটি বস্তু উদ্ধার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে নিহত ও আহতদের উচ্চ-প্রোফাইল মাদক ও সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য বলে জানা গেছে।
ঐ একই রাতে, খুলনা মহানগরীর হরিণটানা থানাধীন রাজবাধ দক্ষিণপাড়ায় বালু ব্যবসায়ী বাবলু দত্ত (৫০)-কে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা জবাই করে হত্যা করে। হরিণটানা থানার ওসি শেখ খায়রুল বাসার বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ৯৫০ মিটার দূরে একটি ফাঁকা জমিতে নিয়ে গিয়ে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি জমি ও বালুর ব্যবসা করতেন। হত্যার পেছনে জমি সংক্রান্ত বিরোধ বা চাঁদাবাজি জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মে মাসে ১১টি খুন, ১১টি ধর্ষণ মামলা (শুধু এপ্রিলেই), ৩০৯টি অপরাধ রেকর্ড করা হয়। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র উদ্বেগজনক। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে খুলনায় ৮০০ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। যার মধ্যে ২২৮টি ধর্ষণ, ১৭০টি শিশু নির্যাতন। আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে এক হাজার ৫৯৮টি। সম্প্রতি বটিয়াঘাটায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, খুলনায় আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন খুন-ধর্ষণ-ছিনতাইয়ের খবর মানুষকে আতঙ্কিত করছে। জনগণের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। প্রশাসনের দায়িত্বশীল আচরণ ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণ অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, আতঙ্কজনিত পরিবেশের কারণে পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছেন না, যার ফলে অপরাধ দমন কার্যক্রমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যখন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপদ ও সমর্থ পরিবেশ পায় না, তখন তাদের কার্যকরী ভূমিকা পালন করা কঠিন হয়ে ওঠে।
খুলনা কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড সিপি) খোন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব, সন্ত্রাসী গ্যাং এবং মাদক ব্যবসার কারণে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। আমরা জনগণের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় থাকবো।